অনিন্দিতা দত্ত
দার্জিলিঙ জেলার মিরিক মহকুমার দুধিয়ায় লোহার সেতু ভাঙার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আর বাড়েনি বলে জানা গেছে। প্রবল বর্ষনে বালাসনের জলচ্ছ্বাসে লোহার সেতুটির তিন নম্বর পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রাতের অন্ধকারে সেতু ভেঙে একরকম নদীর উপর ঝুলছিলো। বালাসনের জল উপছে একের পর এক ঘরবাড়ি নদী গ্রাসে চলে গেছে। সেতু বিপর্যয়ে প্রাণ গেছে অসংখ্য মানুষের। মৃতদের তালিকায় মধ্যে বেশ কয়েকজন শিশু ও মহিলাও রয়েছেন। উপযুক্ত ত্রাণের অভাব প্রকট হচ্ছে। এই অবস্থায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। এই ক্ষোভের আঁচ লক্ষ্য করেই প্রশাসন ও জিটিএ’র অনেকেই এখনও পর্যন্ত মিরিক ও সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় পা রাখতে পারেননি। মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন প্রাকৃতিক দূর্যোগ নেমে আসলে অনেক ক্ষয় ক্ষতি সাধিত হবে এটা তো জানাই ছিলো। এরকমটা আবহাওয়া দপ্তরের আগাম পূর্বাভাষ থাকা সত্ত্বেও আদৌও কি কোন সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিলো ? তাহলে উপযুক্ত ব্যবস্থা আগে থেকেই নেওয়া হলো না কেন ? সরকারের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ ঘোষনাই সার। আসলে দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকায় প্রশাসন বলে কিছু নেই। পাহাড়ের মানুষের এটাই অভিযোগ।
এককথায় বলা যায় সাধারণ মানুষই প্রকৃতপক্ষে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিপর্যয়ের পর থেকেই সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত মিরিক মহকুমার মানুষের পাশে দিন রাত এক করে পড়ে রয়েছেন সিপিআই(এম)’র কর্মীরা। বুধবারও ক্ষোভ উগরে দিয়ে গ্রামবাসীরা প্রকাশ্যে বলেছেন আগে থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ ছিলো। এদিন এই প্রশ্নই বারবার মিরিকের বাতাসে ঘুরে বেড়িয়েছে। তাদের কথায়, উত্তরবঙ্গের বিপর্যয়ের মধ্যেই কার্নিভালে নেচেছেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বজন হারানোদের ব্যাথা উপলব্ধি করার কোন চেষ্টাই নেই মুখ্যমন্ত্রীর। ক্ষতিপূরণ দেওয়াই যেন তার কাছে শেষ কথা।
সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা দার্জিলিঙ জেলা সম্পাদক সমন পাঠকের নেতৃত্বে বুধবার সকালেই ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে পাহাড়ের দূর্গত অঞ্চলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন সিপিআই(এম) কর্মীরা। সোজা মিরিকের সৌরিনীতে পৌঁছে যান তাঁরা। সঙ্গে ছিলেন অনাদি শাহু, ময়ূখ বিশ্বাস, শচীন খাতি, সৌরভ দাস, উদয়ন দাশগুপ্ত, কিসমত তামাঙ, উত্তম শর্মা, চেতন গুরুং, রাজেশ ছেত্রী, রেজিনা রাই, অঙ্কিত দে সহ দলীয় নেতৃত্বরা। প্রতিনিধি দল মিরিকের নয় মাইলে থারবু চা বাগানের ত্রাণ শিবিরে বিতরণ করেছেন। মিরিকের সৌরীনিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় ত্রাণ বিলিবন্টন নিয়ে আলোচনাও করেছেন। স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করেন। সমন পাঠকের নেতৃত্বে সিপিআই(এম)’র প্রতিনিধিদের কাছে পেয়ে সর্বস্ব হারানো মিরিকবাসী বহু মানুষ এগিয়ে আসেন। তাদের ক্ষোভ উগরে দেন। এই বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আর্ত স্বজন হারানো মানুষদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন সিপিআই(এম) দার্জিলিঙ জেলা সম্পাদক। সিপিআই(এম) দার্জিলিঙ জেলা কমিটির পক্ষ থেকে এদিন সর্বত্র যথাসম্ভব ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমন পাঠক ক্ষতিগ্রস্ত পুর্নবাসন দেবার পাশাপাশি এই পরিস্থিতিকে অবিলম্বে 'জাতীয় বিপর্যয়' ঘোষণা করা এবং চা বাগানের শ্রমিকদের জমি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বিপর্যয়ের তিনদিন পরেও গোটা মিরিক ছিলো স্তব্ধ। চারিদিকে বাড়িঘরের কোন চিহ্ন নেই। যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধুই প্রকৃতির তান্ডবে ধ্বংসের ছবি। সেই শনিবার রাত থেকে মিরিকের মানুষের চোখে ঘুম নেই। খাওয়া তো দূরের কথা। স্বজন হারানো পরিবারগুলোকে নিয়েই তাদের যতো উদ্বেগ। নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবারগুলি। হারিয়ে গেছে বাড়ির উপার্জনশীল মানুষটি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভবিষ্যতের চিন্তায় অধীর পরিবারগুলি। রবিবার থেকেই ধস ও ধসের কারণে ধংসস্তুপ সরিয়ে একের পর এক মৃতদেহ উদ্ধারের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এদিকে বিদ্যুৎ নেই। পর্যাপ্ত খাবার নেই। পানীয় জলের সঙ্কট। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। শোকের আধারে অন্ধকার যেন আরও গভীর হয়েছে। কিন্তু খরস্রোতা বালাসন স্রোতের আওয়াজ বাতাসে ভেসে আসছে।
এদিন ধস বিধ্বস্ত এলাকায় পৌঁছে চারিদিক ঘুরে বেড়িয়ে ত্রাণ বিলিবন্টন করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে মানুষের অসহায়তা প্রত্যক্ষ করেছেন সিপিআই(এম)’র প্রতিনিধি দল। ডাবগ্রামের খোলাচাঁদ ফাপড়ির ছোট্ট আয়ূষি ছেত্রী(৮) তার দাদুর বাড়ি সৌরীনিতে বেড়াতে গিয়ে ধসে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। তার দাদু চা শ্রমিক রাজেন ছেত্রী সহ পরিবারের বাকি সদস্যরা এই সময়ে ত্রাণ শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন। এই একই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন সেই পরিবারটি যে পরিবারের একই সঙ্গে চার সদস্যের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে পাহাড়ি ধস। কারো বাড়িতে অতিথি এসে মারা গেছেন। দিল্লির পরিযায়ী শ্রমিক সুনীল থাপার বাড়ি এখন বিপজ্জনকভাবে খাদের কিনারায় ঝুলছে। তাঁর দুই মেয়েও বর্তমানে ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন। কিন্তু কষ্টে বানানো বাড়ি ছাড়তে না চাওয়া স্ত্রী এখনও সেখানে আটকে আছেন। এদিন প্রতিনিধি দল পৌঁছে গিয়েছেন মিরিকের কাছে সৌরীনি অঞ্চলের এই ত্রাণ শিবিরে। এই ত্রান শিবিরের অদূরে বিষ্ণুলাল গাঁও অঞ্চলে এক পরিবারের ১১ বছরের মেয়ে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলো, আর ফিরতে পারেনি। কাছেই ৯ বছরের এক বাচ্চা ছেলেও প্রাণ হারিয়েছে। গোটা এলাকা ধসে স্তব্ধ। নয় মাইল অঞ্চলের আরেক শিবিরে থাকছেন থরবু চা বাগানের আক্রান্তরা। সেখানে দুই ভাইবোন সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে পড়েছেন, যাদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এসেছে শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ। বিপর্যয়ের পরবর্তী সময় থেকে থরবু বাগানের লোয়ার ডিভিশনের শিবিরে থাকছেন ধসে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি পরিবার। ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বশান্ত মানুষদের দাবি, শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় সারলেই হবে না। অতিদ্রুত আমাদের পূর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
Comments :0