উৎপল মজুমদার: ভুতনির চর
ইংরেজবাজার থেকে মানিকচকে ভুতনির চরে আসার রাস্তায় বারবার চোখে পড়েছে বিরাট বিরাট গেট। বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বেশির ভাগই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ অনুমোদিত গেটে রয়েছে বিজ্ঞাপন। রয়েছে পরিচালন সমিতির সম্পাদকের ছবিও।
ভূতনির চরে সিপিআই(এম)’র সমাবেশে এসেছিলেন শুভ মন্ডল। মানিকচক কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে অনার্স পড়ছেন প্রথম বর্ষে। শুভ বললেন এখানকার সরকারি স্কুলগুলোর অবস্থা করুণ কেননা শিক্ষকের অভাব প্রচন্ড। যাঁরা আসছেন ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাচ্ছেন অন্য স্কুলে। শিক্ষক নিয়োগ নেই। ধুঁকছে স্কুলগুলো।
গঙ্গা ফুলহর মিশে যাবে যে কোনদিন। আরো ভয়াবহ হবে ভুতনির চরের অবস্থা। এমনিতেই মানিকচকের এই এলাকার বিভিন্ন অঞ্চল স্রেফ তলিয়ে গিয়েছে।
শুভ জানিয়েছেন, এমন বহু পরিবার রয়েছে যারা বেরোনোর আগে জিনিসপত্র পর্যন্ত ঘর থেকে বের করতে পারেননি। কোনক্রমে নিজেরা ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন। চোখের সামনে তলিয়ে যাচ্ছে আশ্রয়।
ভয়াবহ সংকটে মানিকচক। সিপিআইএম নেতা দেবজ্যোতি সিনহা বলছেন, “এত বড় বিপর্যয়ের সময়ও লুট বন্ধ হয় না। বালির বস্তা দিয়ে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। খাতায়-কলমে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। সেই টাকা যাচ্ছে তৃণমূলের লোকজনের পকেটে।”
মানিকচকে ঘুরলেই বোঝা যাবে মাইক্রোফিন্যান্স আর পরিযায়ী শ্রমিক কেন বড় সমস্যা হয়ে রয়েছে বাংলায়।
সমাবেশের মাঠেই ছিলেন হাসিনা বিবি, মেনি বিবিরা। হাসিনা বিবির স্বামীর সঙ্গে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ঘর ছেড়েছে ছেলেও। বাবা এবং ছেলে কাজ করছে মহারাষ্ট্রের পুনেয়।
হাসিনা বললেন, “যে ঠিকাদাররা বাইরের রাজ্যে কাজ দেয় তারাও সুযোগ বুঝে বিপাকে ফেলতে দেরি করে না। অনেক সময়ই দেরি করে টাকা দেয়। টাকা দেওয়ার জন্য টালবাহানা চালাতে থাকে। গ্রামের বাড়িতে টাকা আসতেও দেরি হয়।”
মেনি বিবি বা হাসিনা বিবির বাড়িতে কেউ বেসরকারি স্কুলে পড়ে না। মেনি বিবি বলছেন, “টিউশন পড়াতেই ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা খরচা হয়ে যায় একেকজনের পেছনে। এরপর প্রাইভেটে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের অন্তত নেই।”
ভূতনির চরের সমাবেশ অন্য আর পাঁচটা জায়গার তুলনায় আলাদা। সমাবেশের মাঠে জমায়েত চোখে পড়ার মতো। মানিকচকের বিধায়ক তৃণমূল কংগ্রেসের সাবিত্রী মিত্র। তাঁকে নিয়ে খুব শুধু সমাবেশের মাঠে নয় আশেপাশের দোকানে বাজারেও বেশ স্পষ্ট। অভিযোগ দুর্নীতির, জনজীবনের যন্ত্রণায় ভূমিকা না নেওয়ার।
সামিনা বিবির ৫ মেয়ে। স্বামীর হাঁটুতে ব্যথা। কাজে বেরোনো প্রতিদিন আরো বেশি কঠিন হচ্ছে। বাড়িতে কার্যত কারো কাজ নেই। কিন্তু তাঁরও মেলে না আবাসের টাকা। দল বেঁধে থাকা মহিলাদের জটলা জানিয়েছে। এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকার অনুদান পেতে তোলাবাজির নির্দিষ্ট রেট আছে। দিতে হবে কুড়ি হাজার টাকা।
মেনি বিবি জানিয়েছেন, মাইক্রোফিন্যান্সের জন্য বহু পরিবার ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিস্তির টাকা শোধ করার নির্দিষ্ট দিন রয়েছে। দিতেই হবে টাকা। বাড়িতে বাউন্সার চলে আসছে রাত বিরেতে। তৃণমূল বা রাজ্য সরকার পরিষ্কার চোখ বুঁজে বসে আছে।
এই দুর্নীতি আর ভাগাভাগি রাজনীতির বিরুদ্ধেই সমাবেশ করেছে ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’। অধিকারের পক্ষে একজন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম)। পার্টি রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, জেলা সম্পাদক কৌশিক মিশ্র থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীনাক্ষী মুখার্জি জানিয়েছেন সেই আহ্বান।
এদিন সমাবেশের পর একেবারে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে মত বিনিময় করেছেন মহম্মদ সেলিম। শুনেছেন তাঁদের সমস্যা। জেনেছেন আকাঙ্ক্ষা।
আরেকটি বৈঠক সভা হয়েছে ভাঙনে সব হারানো পরিবারের সঙ্গে। ছিলেন মীনাক্ষী মুখার্জি, সুমিত দে, দেবজ্যোতি সিনহা সহ সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ।
Comments :0