Editorial

ঐতিহাসিক যাত্রা

সম্পাদকীয় বিভাগ


গত ৩ নভেম্বর সেই কোচবিহার থেকে শুরু হয়েছিল ডিওয়াইএফআই’র ইনসাফ যাত্রা। দীর্ঘ ৫০দিন ধরে রাজ্যের প্রতি‍‌টি জেলা ঘুরে ৫০তম দিনে সেই যাত্রা শেষ হয়েছে দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ডে। এ রাজ্যের যুব আন্দোলন তথা সমগ্র গণআন্দোলনের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এটা এক নজিরবিহীন ঐতিহাসিক ঘটনা। অতীতে হুড়া (পুরুলিয়া) থেকে কলকাতা, কোচবিহার থেকে কলকাতা এবং কলকাতা থেকে হলদিয়া পদযাত্রা হয়েছে। এছাড়া ছোট ও মাঝারি আকারের বহু পদযাত্রা সংগঠিত হয়েছে। সেই সব পদযাত্রাগুলিতে যৌবনের ঢল নামলেও তবে সেগুলি সংগঠিত হয়েছিল প্রধানত সিপিআই(এম)’র উদ্যোগে। এবারের ইনসাফ যাত্রার সংগঠক বাংলার যুব সমাজের অন্যতম প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ডিওয়াইএফআই। অবশ্য আয়োজনের দায়িত্ব যুব সংগঠন নিলেও সমাজের সব অংশের মানুষই তাতে নানাভাবে যুক্ত হয়ে গেছেন। ফলে বাংলার শোষিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত জনগণের ইনসাফের দাবি নিয়ে যুবদের উদ্যোগে এই পদযাত্রা হলেও বাস্তবে তা আমজনতার যাত্রায় পরিণত হয়ে গেছে। শত সহস্র অত্যাচারিতের জীবনযন্ত্রণা আর অশ্রুকে পাথেয় করে আগামী জানকবুল লড়াইয়ের পুঁজি সঞ্চয় করে যাত্রা অতিক্রম করেছে কয়েক হাজার মাইল। পথে পথে তাদের দুঃখ, দুর্দশার কথা অকপটে উগরে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। বারো বছর ধরে অত্যাচারের বধ্যভূমিতে কোনোরকমে টিকে থাকা মানুষের চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল পদযাত্রীদের মধ্যে জেদী লড়াইয়ের দ্যোতনা দেখে। তারা খুঁজে পেয়েছেন লড়াই করে বাঁচার পথ। বাঁচার মতো করে বাঁচার লড়াকু রসদ।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাছাই করা শতাধিক পদযাত্রী থাকলেও আংশিক সময়ের জন্য ১০দিন, ২০দিন, ৩০দিন, ৪০দিনও হেঁটেছেন অনেকে। আবার প্রতিটি জেলায় এবং অঞ্চলে অঞ্চলে তাতে যোগ দিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তাছাড়া এই দীর্ঘ পথে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে পদযাত্রীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন কত লক্ষ মনুষ তার কোনও সীমাপরিসীমা নেই। তেমনি ৫০দিনে ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে কত হাজার সভা-সমাবেশ হয়েছে এবং তাতে সব মিলিয়ে কত লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছে তারও কোনও কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ৫০ দিন ধরে যারা হেঁটেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন যাত্রাকে ঘিরে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, উচ্ছ্বাস, লড়াইয়ের প্রেরণা, জেদ, হার না মানা মনোবল তাদের ধারণা কম করে ১৫ লক্ষ মানুষ জুড়ে গেছেন পদযাত্রাকে ঘিরে।
এযাত্রা কোনও যুবরাজের সখের বিলাসী যাত্রা ছিল না। পথে পথে আরামের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসী তাঁবু খাটানো ছিল না। ছিল না কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের বিলাস ব্যসন। ছিল না যাত্রার আয়োজনে গোটা রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশের অতি সক্রিয়তা। ছিল না জেড প্লাস নিরাপত্তা, ছিল না হেলিকপ্টারের বাহাদুরি এবং শত শত বিলাসবহুল গাড়ির কনভয়। আসেনি ফাইভ স্টার হোটেলের দামি খাবার। গ্রামের গরিব মানুষ তাদের সাধ্যমত ডাল-ভাত, খিচুড়ি যা জোগাড় করতে পেরেছেন সেটাই পদযাত্রীরা রাস্তায়-মাঠে বসে খেয়েছেন। দরদি মানুষরা নিজের বাড়িতে, ক্লাব ঘুরে, স্কুলবাড়িতে শোবার ব্যবস্থা করেছেন। জনজীবনের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে গোটা পদযাত্রা। কৃষক, খেতমজুর, দিনমজুর, পরিযায়ী শ্রমিক, চা শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, মৎস্যজীবী, খাদান শ্রমিক, আদিবাসী ইত্যাদি সকল অসহায় মানুষ সংগ্রামী উত্তাপ গ্রহণ করেছেন পদযাত্রায় মিশে। গ্রামে গ্রামে সেই উত্তাপ বার্তা বয়ে নিয়ে গেছে ৭ জানুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশের। সেই সমাবেশে লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে সোচ্চারিত হবে ইনসাফের দাবি। খুনের বিচার চাই, বেকারের কাজ চাই, সকলের শিক্ষা চাই, ন্যায্য মজুরি চাই, চিকিৎসার সুযোগ চাই ও ফসলের দাম চাই। যদি দিতে না পারো গদি ছেড়ে দাও। যদি না ছাড়ো তবে এই ইনসাফের দাবিদাররাই টেনে নামাবে গদি থেকে।

Comments :0

Login to leave a comment