জয়ন্ত সাহা: ময়নাগুড়ি
এবারেই শুধু নয়, উত্তরবঙ্গে টর্নেডো এসেছিল ২০২২সালেও। কিন্তু সেই টর্নেডোর থেকে কোনও শিক্ষাই নিতে পারেনি রাজ্য সরকার। সেবারে এরকম ঝড়েই ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে এসেছিল ডুয়ার্সের এক বড় অংশে। কার্যত বেসামাল হয়ে পড়েছিল প্রশাসন। এবছর রবিবার বিকেলে হঠাৎ আসা টর্নেডো ঝড়ে ময়নাগুড়ির বিধ্বস্ত তিনটি গ্রামের মাথার ওপরের ছাদ মুহূর্তে উড়ে যাওয়ার পর মানুষ আরও একবার বুঝলেন এখন আর প্রশাসন নয়, রাজ্যে অতিমারিই হোক কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যাই হোক না কেন প্রশাসনের অনেক আগেই জীবন বাজি রেখে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে পারে রেড ভলান্টিয়াররাই।
রবিবার ভোটের প্রচারে ওদলাবাড়িতে ছিলেন এসএফআই’র সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস। বিপর্যয়ের খবর পেয়েই এথেলবাড়ির ঘন জঙ্গল পেরিয়ে বাইকের পেছনে রেড ভলান্টিয়ার অরিন্দম ঘোষকে নিয়ে তিনি পৌঁছান বিপর্যস্ত এলাকায়। অবশ্য তার আগেই রেড ভলান্টিয়ার অর্পণ পাল, অপূর্ব সরকার, প্রীতম রায়, তন্ময় রায়ের মতো ৩০ জনের রেড ভলান্টিয়ারের টিম পৌঁছে গিয়েছিলেন সেখানে। তাঁদের সঙ্গে ছিল বেঁচে থাকার আশু উপকরণ জলের বোতল, গুঁড়ো দুধ, ছাতু, শুকনো খাবার ও প্রয়োজনীয় ওষুধ। এলাকার মৌলানী, রাজারহাট, পুঁটিমারি অঞ্চলে তখন প্রায় আড়াইশো বাড়ি ভেঙে পড়েছে। ভেসে আসছে বিপন্ন মানুষের কোলাহল আর কান্নার আওয়াজ।
রাস্তায় তখন পড়ে রয়েছে বড় বড় গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি। জেলা শাসক থেকে পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা টিমের কর্তারা ঠায় দাঁড়িয়ে রাস্তা সাফ হবার অপেক্ষায়। ততক্ষণে রেড ভলান্টিয়াররা দুর্গম পথ পার হয়ে পৌঁছে গেছেন বিপন্নদের পাশে। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো, তাঁদের ভাঙাঘরের জিনিসপত্র, ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়া প্রতিবেশীদের ঘরে রাতভর পরিশ্রম করে পৌঁছে দিয়েছেন রেড ভলান্টিয়াররাই। প্রশাসন পুঁটিমারি উচ্চ বিদ্যালয় আর বার্নিশ উচ্চ বিদ্যালয়ে ত্রাণ শিবির খুলেছিল। কিন্তু সেখানে মাত্র ২০/২৫টি পরিবারকেই খেতে দেখা গেছে, এর বাইরে কেউ যাননি।
রেড ভলান্টিয়ার অর্পণ পাল-এর কথায়, যেসব পরিবার দুর্যোগের শিকার হয়েছে, ঝড় থামার পর তাঁরা ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সংসারের জিনিস সামলানোকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অপর রেড ভলান্টিয়ার অপূর্ব সরকার বলেন, রবিবারের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর স্পষ্ট হলো আমাদের জেলায় বিপর্যয় মোকাবিলা টিম বলে কিছুই নেই! রবিবার রাতভর দুর্যোগের শিকার হওয়া ৩টি গ্রামের মানুষ নিজেদের ঝড়ের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া সংসারের সামগ্রী বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টার মধ্যেই শুনেছেন মুখ্যমন্ত্রী আসছেন, আসছেন রাজ্যপাল। কয়েক মিনিটের ঝড়ে মাথার ওপরের টিনের চালা হারিয়ে মানুষগুলো তখন রেড ভলান্টিয়ারদের দেওয়া জলের বোতল, শুকনো খাবার, ছাতু সন্তানের মুখে তুলে দিতে ব্যস্ত। কেউবা পরিবারের আহতদের নিয়ে ছুটেছেন হাসপাতালে। রেড ভলান্টিয়ারেরা রবিবার রাতেই ফোনে যোগাযোগ করেছেন শ্রমিক, কৃষক, মহিলা নেতাদের সঙ্গে। রাতেই ত্রাণ নিয়ে তাঁরা পৌঁছেছেন দুর্গতদের কাছে।
সোমবার ময়ূখ বিশ্বাস বলেন, জলপাইগুড়ির সিপিআই(এম) প্রার্থী এবং সিপিআই(এম) নেতারা যখন প্রচার কর্মসূচি মুলতুবি রেখে ত্রাণে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তখন মুখ্যমন্ত্রী আর রাজ্যপাল আসবেন বলে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ত্রাণের কাজ বন্ধ রাখল প্রশাসন। সবাই এলেন এবং ময়নাগুড়ির বার্নিশ, রাজারহাট আর পুঁটিমারি গ্রামের ঝড়ে বিধ্বস্ত গুটিকয়েক বাড়িতে দেখা করে সমবেদনা জানিয়েই আবার ফিরে গেলেন।
অথচ সোমবার সকাল থেকেই রেড ভলান্টিয়াররা ঘুরেছেন বাড়ি বাড়ি। বিপর্যয়ের পর ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও রাত পর্যন্ত ময়নাগুড়ির ওই ৩টি গ্রামের সব বাড়িতে সরকারি লোকেরাই পৌঁছায়নি, ত্রাণ তো দূরের কথা। রেড ভলান্টিয়ার তন্ময় রায় বলেন, এদিন অনেক বাড়ির লোকজন আমাদের বলেছেন,‘সিভিক ভলান্টিয়াররা এসে আধার কার্ডের ছবি আর ভাঙা বাড়ির ছবি তুলে নিয়ে গেছে, কিন্তু তারা খেতে দেয়নি। তোমরা এসেছিলে। তাই জল, শুকনো খাবার, ছাতু আর গুঁড়ো দুধ পেলাম।
সোমবার বিকেলে সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছে তখন নিজেরাই সূর্য হয়ে বিপন্ন পরিবারগুলির কাছে শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়ে নতুন করে বাঁচার আলো ফুটিয়েছেন তরুণ তুর্কি রেড ভলান্টিয়াররা। তাঁরা বিপন্ন মানুষকে বলছেন, ‘এই দুর্যোগে প্রশাসন পাশে থাকুক আর না থাকুক, রেড ভলান্টিয়াররা আপনাদের পাশে আছে।’ রাজারহাটের বিপন্ন পরিবারের অভয় রায়, পিন্টু রায়, নান্টু রায়, পুঁটিমারির দিলীপ রায়, বড়কামাতের চণ্ডী রায়েদের মতো অনেক পরিবারের কাছেই রেড ভলান্টিয়ারেরাই একমাত্র সহায়।
Red Volunteers
রাত থেকেই খাবার, ওষুধ নিয়ে মানুষের পাশে রেড ভলান্টিয়াররা
×
Comments :0