বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য
জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা ভোটে জেতার জন্য কোনও চেষ্টারই কসুর করতে পিছপা হয়নি আরএসএস-বিজেপি, কিন্তু শেষ অবধি ‘কাশ্মীরিয়ত’ এর ‘ইমানে’র কাছে হারতেই হলো মোদী-শাহ জুটিকে ।
দীর্ঘ দশ বছর পরে বিধানসভা ভোট হলো উপত্যকায়, এই দশ বছরের মধ্যে প্রথম চার বছর বিজেপি , পিডিপি’র সাথে জোট করে সরকার চালিয়েছে, তারপর সেই সরকার ফেলে দিয়ে সেনা দিয়ে গোটা উপত্যকা ঘিরে কার্ফু জারি করে সংবিধান প্রদত্ত কাশ্মীরের জন্য বিশেষ ধারা ৩৭০ ও ৩৫ এ বাতিল করেছে, রাজ্য ভেঙে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ে লাদাখকেও আলাদা করে দিয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই মুহূর্তে বিধানসভা ভোট করাতে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হলেও, জম্মু -কাশ্মীর তাঁর পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা কবে পাবে সেটা এখনও ঠিক হয়নি । দিল্লির নির্দেশে থুরি বিজেপি’র নির্দেশে আর কতদিন সেখানে নিযুক্ত উপরাজ্যপালই প্রকৃত শাসন জারি রাখবেন সেটা কেউ জানে না। নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদের হাতে প্রশাসনিক ক্ষমতা তুলে দেওয়ার দাবিই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এই প্রসঙ্গে আরএসএস তথা বিজেপি’র গুরুত্বপূর্ণ নেতা রাম মাধব ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে জানিয়ে রেখেছেন– জম্মু-কাশ্মীরকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফেরতের আগে কেন্দ্রকে নিশ্চিত করতে হবে, সেই সব ‘ভয়ঙ্কর’ দিন যেন ভূস্বর্গে আর ফেরত না আসে। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে , আরএসএস’র সম্মতি নেই ।
এন সি–কংগ্রেস–সিপিআইএম-কে নিয়ে গঠিত বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ জম্মু-কাশ্মীরে ভোটে জিতুক এটা স্বাভাবিকভাবে কখনই চায়নি আরএসএস-বিজেপি। জম্মু-কাশ্মীরকে কবজা করতে তারা অনেকগুলো কৌশল নিয়েছিল। বিধানসভা কেন্দ্রগুলোর সীমানা পুনর্বিন্যাসের নামে হিন্দুপ্রধান জম্মুতে বাড়ানো হয়েছে ৬টি আসন, মুসলমানপ্রধান কাশ্মীরে ১টি। তারপরেও, আইন করে উপরাজ্যপালকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বিধানসভায় পাঁচজনকে মনোনীত করার, যাঁদের আবার ‘ভোটাধিকার’ও থাকবে। আসন পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বিজেপি চেয়েছিল জম্মুতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোট ধরে রেখে কাশ্মীর উপত্যকায় বিরোধী ভোট ভাগ করে দেওয়া যাতে বিজেপিই সর্বোচ্চ আসন পায় আর তারপর ছোট ছোট দল বা নির্দলের সাহায্য নিয়ে কাশ্মীরের ক্ষমতা দখল। এই খেলায় তারা প্রকাশ্যে মদত দিয়েছে জামাত ই ইসলামি সহ বিভিন্ন মৌলবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকেও। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জেরে জম্মুতে তাদের কৌশল কিছুটা সফল হলেও বিস্তীর্ণ কাশ্মীর উপত্যকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট এন সি তথা ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পক্ষেই গিয়ে বিজেপি’র হিসাব গোলমাল করে দিল। আসলে, উপত্যকার সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছিল বিজেপি’র মদতেই বিভিন্ন ছোট দল যেমন আপনি পার্টি, আজাদ পার্টি আর বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলো ভোট ভাগের খেলায় নেমেছে। অগণতান্ত্রিকভাবে ৩৭০ ধারা রদের অনুভূতি এখনও যায়নি কাশ্মীরিদের মন থেকে , তাই তারা এবার বিজেপি-কে জবাব দিলেন গণতান্ত্রিকভাবেই। মোট ৯০ আসনের বিধানসভায় এই মুহূর্তে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের পক্ষে রয়েছেন ৫৪ জন বিধায়ক। আর বিজেপি’র কাছে ২৯ জন বিধায়ক। ভোট শতাংশের হিসাবে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ পেয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট আর বিজেপি পেয়েছে ২৫ শতাংশ ভোট। তাই এখন মোদী-শাহ জুটির কাছে হার স্বীকার করা ছাড়া আর কোনও উপায়ই ছিল না ।
তিন দশকের একটানা পাক মদতপুষ্ট হিংস্র সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ,কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর আক্রমণ ও হত্যা ,তল্লাশি ও সন্ত্রাস দমনের নামে নিরীহ কাশ্মীরিদের ওপর সেনাবাহিনীর অত্যাচার– দীর্ণ করেছে কাশ্মীরকে। এরপরেও পর্যটকেরা আনন্দ নিয়েই ফিরেছেন ঝিলাম থেকে,মুগ্ধ হয়েছেন তাঁদের আতিথেয়তায়। আসলে গণতন্ত্রে বিভিন্ন মাত্রা থাকে, উগ্র জাতীয়তাবাদই একমাত্র মাত্রা হতে পারে না। বিকল্প স্বর গণতন্ত্রের স্বার্থেই অত্যন্ত প্রয়োজন। বিশাল ভারতীয় ভূখণ্ডে পরিচিতির দ্বন্দ্ব যদি কোথাও থেকে থাকে সেটা প্রকটভাবে আছে কাশ্মীরেই। জোর জবরদস্তি করে সেনা বিছিয়ে জমি দখলে এলেও কাশ্মীরিদের বিশ্বাস অর্জন সম্ভব নয় যেটা সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় সম্ভব ছিল। দৈনন্দিন ব্যবহারে ৩৭০ ধারার তেমন কোনও গুরুত্ব ছিল না কিন্তু সেটা ছিল দেশভাগের সময়ে ‘স্বাধীন’ রাজ্যে কাশ্মীরের ভারতভুক্তির শর্ত। ফলে কাশ্মীরিদের কাছে সেটা ছিল একটা আবেগ এবং অলঙ্কার। ৩৭০ ধারা বাতিলের মত ফ্যাসিস্ত পদক্ষেপে গোটা কাশ্মীরবাসী অনুভব করেছে নাগরিক থেকে প্রজা হবার গ্লানি। অস্তিত্ব সঙ্কট বা পরাধীনতা যেটাই বলা হোক সেটা ছিল কাশ্মীরিদের চোখে মুখে। তাই খুব পরিণতভাবেই গণতান্ত্রিক পথকেই সমস্যা সমাধানের জন্য এবার বেছে নিলেন কাশ্মীরিরা। এবারের ভোটে ৬৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। গত আটটা ভোটের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে ভোটদানের এই শতাংশ। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের কথায়–'বিজেপি যতই তাদের কৃতিত্ব দাবি করুক সফল নির্বাচনের সেটা ঠিক নয়। কারণ মানুষ নির্বাচনের রায়ে তাদেরই প্রত্যাখান করেছে। দশকের পর দশক জুড়ে টানা সহিংসতায় ক্লান্ত হয়ে কাশ্মীরিরা নিজেরাই এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা গণতান্ত্রিক উপায়েই শান্তি ফিরিয়ে আনবেন, ফিরিয়ে আনবেন তাদের পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা’। তাদের বক্তব্য পরিষ্কার, ব্রিটিশ আমলে যেভাবে লন্ডনের ঠিক করা ভাইসরয় ভারত শাসন করতেন,এখানেও সেরকমভাবে দিল্লির ঠিক করা উপরাজ্যপাল কাশ্মীর শাসন করছেন ।এই অপমানজনক অধ্যায়ের শেষের জন্যই এবারের ভোট সফল ও তার ফলাফলও সকলের চোখের সামনে রয়েছে। এবার দিল্লি ঠিক করুক তারা সত্যিই অন্যান্য রাজ্যের মতই জম্মু-কাশ্মীরকে গণতান্ত্রিকভাবেই দেখতে চায় কি না।
Comments :0