POST EDITORIAL UGC CIRCULAR

স্মৃতিবিকৃতির এক বিষাক্ত ভাষ্য

সম্পাদকীয় বিভাগ

সম্প্রতি ইউজিসি’র চেয়ারম্যান এম জগদীশ কুমারের সই করা একটি সার্কুলার সামনে এসেছে। সেই সার্কুলার নিয়ে মিডিয়াতে আলোচনাও হয়েছে।  এম জগদীশ কুমার জেএনইউ’র উপাচার্য পদে থাকাকালীন পড়ুয়াদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের নামে যথেষ্ট কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান প্রেক্ষিতে ইউজিসি’র চেয়ারম্যান পদে তাঁর  উত্তরণ আমাদের মতো অনেককেই অবাক করেনি। বর্তমানে তিনি সাভারকার, গোলওয়ালকারের মতো ব্যক্তিদের ভাষ্য, বক্তব্য এবং আদর্শকে ভারতবর্ষের উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈধতা দেওয়ার প্রশ্নে মনোনিবেশ করেছেন। আরএসএস দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চশিক্ষায় এঁদের বৈধতা পাইয়ে দেওয়ার বিষয় সক্রিয়। কিন্তু এতদিন সেই প্রক্রিয়ায় একটা গোপনীয়তার মোড়ক ছিল। এম জগদীশ কুমার এই সমস্ত কিছুর তোয়াক্কা না করে সবটাই খোলামেলা ভাবে করছেন। 
ইউজিসি’র বর্তমান চেয়ারম্যান সরকারিভাবেই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টরিক্যাল রিসার্চ বা আইসিএইচআর-কে নিজেদের রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের অঙ্গ হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে, দেশের প্রথম সারির ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্রকে এক প্রকার গায়ের জোরে দখল করে ফেলেছে হিন্দুত্ববাদী পদাতিকরা।


রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা মোদীই


বর্তমান সরকারের ট্র্যাক রেকর্ডের জন্য সারা বিশ্বজুড়েই নরেন্দ্র মোদীকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। নানান দেশের  রাজনৈতিক পণ্ডিত এবং বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার অগণতান্ত্রিক, মানবতা বিরোধী, মানবিক অধিকারকে দমন করে এবং ভারতীয় সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। এই সমালোচনার মুখে লাগাম পড়াতে নরেন্দ্র মোদীর চলতি বছরের স্বাধীনতা দিবসকে বেছে নেন। লালকেল্লার প্রাকারে দাঁড়িয়ে একটি ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। ভাষণে তিনি জানান, ভারতবর্ষ হলো গণতন্ত্রের মাতৃভূমি। মোদী কোনদিনও নিজের আরএসএস’র শিকড়কে অস্বীকার করেননি। সাভারকার এবং গোলওয়ালকার চিরকাল ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নিজেদের ভ্রান্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে এসেছে। নরেন্দ্র মোদীও সেই আদর্শ এবং মার্গের সমর্থক, যেই আদর্শ ইতিহাসকে ভিত্তি করে মনগড়া রম্য কাহিনি রচনা করে। এবং সেই কাহিনিগুলিকে ইতিহাস বলে প্রচার করে এবং তার ভিত্তিতে সমাজে বিভাজন ছড়ায়। 
বর্তমানে বিজেপি’র মারফত ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে আরএসএস। তাঁরা মনে করছে সরকারি ক্ষমতাকে ব্যবহার কিংবা অপব্যবহার করে নিজেদের সুবিধামতো এবং মনোমত ইতিহাস পুনঃনির্মাণ করা সম্ভব। ইতিহাসকে বদলে ফেলা সম্ভব। আরএসএস মনে করে, ভারতবর্ষের বর্তমান সংবিধানকে বদলাতে গেলে দেশের ইতিহাসকে বদলাতে হবে। ভারতবর্ষের ইতিহাস সংমিশ্রণের ইতিহাস, বহুত্ববাদের ইতিহাস এবং উদারবাদের ইতিহাস। সংবিধানের হাড় এবং মজ্জা থেকে বহুত্ববাদ এবং উদারবাদকে সরাতে গেলে সবার আগে ইতিহাসকে বদল করা প্রয়োজন। এবং এই বদল ঘটাতে পারলেই অসাম্প্রদায়িক সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া সম্ভব।


কনসেপ্ট নোট 


সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আইসিএইচআর’র তরফে একটি কনসেপ্ট নোট প্রকাশ করা হয়েছে। সেই নোটের  নাম রাখা হয়েছে ‘ভারত, লোকতন্ত্র কি জননী’।  এই কনসেপ্ট নোটটি আদতে কল্পকথার নামান্তর।  প্রথম লাইন থেকেই স্পষ্ট হয়েছে, এই নোট তৈরির পিছনে কোনোরকমের কোনও গবেষণার ভূমিকা নেই। ভারতের ইতিহাস গবেষণা এবং চর্চা একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু  ‘ভারত লোকতন্ত্র কি জননী’ প্রকাশনায় প্রথম থেকেই  সমস্ত ধরনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নাকচ করা হয়েছে। সহজ উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস নির্ধারণের ক্ষেত্রে জিন বিদ্যা বা জেনোম সিকুয়েন্সের বিশাল বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আইসিএইচআর’র প্রকাশিত লেখায়  ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে জেনমিক্স সহ অন্যান্য প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণাকে কার্যত অচ্ছুৎ ঘোষণা করা হয়েছে। আরএসএস কীভাবে আইসিএইচআর-কে দখল করে ফেলেছে, তা এই কনসেপ্ট নোট থেকেই পরিষ্কার। 
আরএসএস চাইছে দেশের উচ্চশিক্ষার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইতিহাসের নামে কল্পকথার আমদানি করতে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা। কিন্তু আশঙ্কা বা উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলাও সমানভাবে জরুরি, যাতে কোনও সংগঠন দেশের এবং সমাজের ইতিহাস নিয়ে এমন কারচুপি বা ছেলে খেলা করার সাহস না পায়।

এই কনসেপ্ট নোটে দাবি করা হয়েছে, আদি অনন্তকাল ধরে ভারত থেকে বহির্বিশ্বে মানুষ ‘মাইগ্রেট’ করেছে। তাই ‘ভারত’ ধারণাকে আরও বেশি করে উদ্‌যাপন করা প্রয়োজন। অথচ ঐতিহাসিকভাবে এই ধরনের দাবির কোনও ভিত্তি নেই। জিনগত গবেষণা বা জিনোম সিকোয়েন্সিং বা ডিএনএ সিকোয়েন্সিং-এর মাধ্যমে এই তথ্য প্রমাণিত, যে বাস্তবে উলটোটাই হয়েছে। একের পর এক যুগে বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে মানুষ ভারতবর্ষে এসেছে, এবং ভারতবর্ষকে নিজেদের স্থায়ী বাসস্থান হিসাবে বেছে নিয়েছে। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার অভিনবত্ব এই মানব প্রবাহের ফলেই সম্ভব হয়েছে। অথচ আরএসএস মনে করে, ভারতের ইতিহাসে বাইরের থেকে আসা জনগোষ্ঠীর কোনও ভূমিকা নেই। বরং এই জনগোষ্ঠীগুলি দেশের ইতিহাসকে কলুষিত করেছে। সমাজকে কলুষিত করেছে। আরএসএস’র ধারণা অনুযায়ী, কোনও এক প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ থেকে আউটওয়ার্ড মাইগ্রেশন হয়েছে এবং সেই জনগোষ্ঠী সারা বিশ্বে সভ্যতার আলো  জ্বালিয়েছে। যদিও এই ধারণার বাস্তব কোনও ভিত্তি নেই। কিন্তু  আরএসএস তাতে দমার পাত্র নয়। ঔপনিবেশিক যুগের হাতেগোনা কিছু লেখকের ভারতীয় গ্রাম ব্যবস্থা বা গ্রামীণ সমাজ সম্পর্কিত লেখাকে হাতিয়ার করে আরএসএস নিজেদের ধারণাকে ঐতিহাসিক সত্যের রূপ দিতে বদ্ধপরিকর।
উনবিংশ শতকের গোড়া থেকেই চার্লস মেটক্যাফ, জেমস মিল, মাউন্ট স্টুয়ার্ট এলফিনস্টোন, হেনরি মেইন সহ ইংরেজ ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বৈধতা দিতে এক ধরনের ভাষ্য তৈরি করেছিলেন। আরএসএস সেই ঔপনিবেশিক  ভাষ্যকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে এবং সেটিকেই দেশের ঐতিহাসিক ভিত্তি হিসেবে প্রমাণ করতে মরিয়া। 
কনসেপ্ট নোটে দাবি করা হয়েছে, বৈদিক যুগ থেকে ভারতবর্ষে দুই ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল। একটি ছিল জনপদ এবং অপরটি রাজ্য। এই নোটের দাবি অনুযায়ী, এই স্বশাসিত এবং স্বনির্ভর গ্রামীণ ব্যবস্থাগুলি কোনোরকম কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই গড়ে ওঠে। এবং কেন্দ্রীয় নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা না পড়ার ফলে উত্তাল সময়েও এই গ্রামীণ জনপদগুলি নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছিল। ফলে ভারতীয় কোনও শক্তিকে উৎখাত করে বাইরে থেকে আসা কোনও শক্তি সাম্রাজ্য বিস্তার করলেও গ্রামীণ সমাজের উপর তার বিশেষ প্রভাব পড়েনি ঐতিহাসিকভাবে। কনসেপ্ট নোটে বলা হয়েছে, হরিয়ানার কুখ্যাত খাপ পঞ্চায়েতও নাকি এই জাতীয় প্রাচীন, গণতান্ত্রিক গ্রামীণ কাঠামোর অংশ। 
মজার বিষয় হলো, এই স্বশাসিত এবং স্বনির্ভর গ্রামীণ ব্যবস্থার কথা প্রথম তুলে ধরেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদরা। স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ উদ্‌যাপনের জন্য এই মতবাদকেই নতুন করে তুলে ধরছে আরএসএস পোষিত তথাকথিত ইতিহাস গবেষকরা। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের যাবতীয় ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা হচ্ছে।  আরএসএস’র স্বাধীনতা সংগ্রামে ন্যূনতম কোনও ভূমিকা ছিল না। তাই দেশের স্বাধীনতার ৭৫ তম বছরে তাদের পক্ষে নিজেদেরকে মেলে ধরার কোনও অবলম্বন নেই। এই ঘাটতি ঢাকার জন্যই কাল্পনিক  ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হচ্ছে তাদের।


ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং বর্ণাশ্রমের হয়ে সাফাই


কনসেপ্ট নোট তুলে ধরার সময় ইউজিসি চেয়ারম্যান মঞ্চে দাঁড়িয়ে সীমাহীন কল্পনার ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর চেষ্টা করেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে রাজতান্ত্রিক মনে করা হলেও আদপে তা গণতান্ত্রিক। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, সেই সময় রচিত গ্রন্থগুলি, সেই সময়ের মুদ্রা, শিলালিপি এবং ভক্তি আন্দোলনের বিন্যাস সহ একাধিক ঐতিহাসিক প্রমাণ প্রাচীন ভারতের গণতান্ত্রিক চরিত্রের স্বাক্ষর বহন করে। সম্প্রতি রাখিঘাড়ি এবং সানাউলিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালানো হয়েছে। সেখান থেকেই উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দেও ভারতে স্বশাসিত গণতন্ত্রের ভিত্তি ছিল।’’
কোনোরকম বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ ছাড়া, কেবলমাত্র মনে হওয়ার ভিত্তিতে কেন্দ্রের তরফে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে যে প্রাচীন ভারতে প্রজাতন্ত্র কিংবা জনতন্ত্র নয়, বরং লোকতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। যেখানে লোকতন্ত্রের মানে সামাজিক বিকাশশীল গণতন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্র মানে বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামোর রকম ফের। 
কাল্পনিক বিনির্মাণের এখানেই শেষ নয়। এই কনসেপ্ট নোটের দাবি অনুযায়ী প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থায় অদ্ভুত সমতা ছিল। এখানে অর্থের জোরে কিংবা পারিবারিক প্রতিপত্তির জোরে, কিংবা রাষ্ট্র ক্ষমতার জোরে কেউ বাড়তি সুবিধা ভোগ করতে পারত না। এককথায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোয়  স্বৈরাচারের কোনও স্থান ছিল না। তার ফলে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল গ্রিস কিংবা রোমের থেকেও গণতান্ত্রিক। ভারতীয় রাষ্ট্র এবং সমাজের সার্বভৌমত্ব পরিচালিত হতো সুসংহত আইনের মাধ্যমে যাকে ‘ধর্ম’ বলা হয়ে থাকে। 
এই কনসেপ্ট নোট যে শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদদের মতবাদকে নতুন করে সামনের সারিতে নিয়ে এসেছে তাই নয়, দেশের বহুত্ববাদী চরিত্রকে  নাকচ করে দিয়ে ইতিহাস রচিত হচ্ছে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং হিন্দুত্ববাদী আচার এবং ভাষ্যকে মাথায় রেখে। ভারতের ইতিহাস নিজের চলার পথে অজস্রবার বেদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এসেছে। লোকায়ত কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের মতো এমন অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে ইতিহাসের পথপ্রান্তরে। কিন্তু আইসিএইচআর’র তাত্ত্বিকরা সেই সমস্ত কিছুকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ইতিহাস রচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাভারকারের মতবাদ  আঁকড়ে ধরে কনসেপ্ট নোটে দাবি করা হয়েছে সিন্ধু সভ্যতা এবং বৈদিক সভ্যতার শিকড় নাকি এক! যদিও ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অন্য কথা বলছে।
এই কনসেপ্ট নোটে পৌরাণিক আখ্যান এবং ইতিহাসের মাঝখানের প্রভেদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। পৌরাণিক সংজ্ঞা অনুযায়ী হিমালয়ের দক্ষিণে এবং ভারত মহাসাগরের উত্তরের গোটা ভূমি খণ্ডকে ভারত রাষ্ট্র এবং তার অধিবাসীদের ভারতীয় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে কনসেপ্ট নোটে। গোলওয়ালকার এবং সাভারকারের রাষ্ট্র সম্পর্কিত বক্তব্যগুলিকে হুবহু বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কনসেপ্ট নোটের পাতায় পাতায়। এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ঐতিহাসিক বিডি চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘প্রাচীন ভারতবর্ষের সংজ্ঞাকে বর্তমান ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চশমা দিয়ে দেখলে হবে না।  প্রাচীন ভারতবর্ষের সংজ্ঞা নির্মাণের সময়ে সীমান্ত কাঁটাতার কিংবা বহিরাগত জাতি— এই ধরনের ভাবনার অস্তিত্বই ছিল না।’’
এ কনসেপ্ট নোটে অভিযোগ করা হয়েছে, ভারতীয়রা এই প্রাচীন গৌরবের সঙ্গে একাত্ম হতে পারছে না,  এবং বর্তমান  সামাজিক বিভেদের জন্য দায়ী করা হয়েছে বহিরাগত ও বিজাতীয় হানাদারদের। এর জন্য যে মূল দায়ী বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা, সেই তথ্য ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে প্রতি পরতে পরতে। বর্ণাশ্রমের মাধ্যমে দলিত সহ অন্যান্য অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের  উপর হাজার হাজার বছর ধরে অমানুষিক অত্যাচার হয়ে এসেছে, এই তথ্যকে অস্বীকার করে কনসেপ্ট নোটে দাবি করা হচ্ছে, বৈদিক যুগ থেকেই লোকতান্ত্রিক পরম্পরায় ভেসে রয়েছে ভারতীয় সমাজ, যার মূলে রয়েছে সামাজিক ন্যায় এবং সমতার ধারণা। 
প্রাচীন ভারত সম্পর্কিত হিন্দুত্ববাদী ধারণার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আইসিএইচআর’র নোটে দাবি করা হয়েছে ভারত রাষ্ট্রের বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামোর মূল ভিত্তিগ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল প্রাচীন এক স্বর্ণযুগে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বহুমাত্রিক চেতনায় ভর করে বর্তমান ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠেছে- আইসিএইচআর’র নোটে এই ঐতিহাসিক তথ্যটিকে কায়দা করে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আসলে এই চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি করে চলেছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আসলে বহুত্ববাদের ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করে এবং সমাজের ‘কালেকটিভ মেমোরি’ থেকে তাকে মুছে ফেলতে পারলে, ভবিষ্যতে একমাত্রিক জাতীয় চেতনা তৈরি করার সহজ হবে আরএসএস’র পক্ষে। আইসিএইচআর’র নোটে যে ব্রাহ্মণ্যবাদকে স্বর্ণালংকারে ভূষিত করা হয়েছে, সেই ব্রাহ্মণ্যবাদই দলিত,মহিলা এবং সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষের প্রতি যুগ যুগ ধরে একের পর এক ঘৃণ্য  অপরাধ সংগঠিত করে এসেছে।


যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আক্রমণ 


সংবিধান অনুযায়ী দেশের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিষয়, বা যৌথ তালিকার অন্তর্গত। বর্তমানে ইউজিসি এবং কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের সেই ধারাকে অগ্রাহ্য এবং অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। উচ্চ শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার কুক্ষিগত করার চেষ্টা চলছে, যাতে আরএসএস এর পক্ষে উচ্চশিক্ষায় নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। 
ইউজিসি বা ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান অনুযায়ী ইউজিসির কাজ হলো, ‘সারা দেশের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন করা, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতামান নির্ধারণ করা, সারা দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পরীক্ষা ব্যবস্থার মান যাতে মোটের উপর সমান থাকে সেটি দেখা, গবেষণার ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত সাহায্য করা, এবং সারা দেশে উচ্চশিক্ষার বিকাশের জন্য তহবিলের ব্যবস্থা করা।’
রাজ্যগুলির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির আচার্য পদে রয়েছেন রাজ্যপালরা। রাজ্যপালদের নিয়োগ করে কেন্দ্র। সংবিধানে কোথাও বলা হয়নি এই রাজ্যপালরা রাজ্য সরকারকে ডিঙিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, বা নিজেদের ইচ্ছেমতো কোনও কাজ করতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারও জরুরি অবস্থা ছাড়া সরাসরি রাজ্যপালকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না। কেন্দ্র যদি রাজ্যগুলির উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চায়, তাহলে সেটা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেই করতে হবে। কিন্তু আমরা কী দেখছি? ইউজিসি’র চেয়ারম্যান রাজ্যগুলিকে এড়িয়ে সরাসরি  রাজ্যপালদের লিখিত নির্দেশ দিয়ে জানালেন, আইসিএইচআর’র নোটের উপর উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। অর্থাৎ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান সংবিধানকেই অগ্রাহ্য করে বসলেন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের চলার পথ সহজ করতে। এর আগেও কেরালার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের মাধ্যমে কেরালার উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে অচলাবস্থা  সৃষ্টির চেষ্টা  করেছে কেন্দ্র। আরিফ মহম্মদ খানদের মতো রাজ্যপালদের কার্যকলাপ থেকে শুরু করে, বর্তমান ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাণ্ডকারখানা- এর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সবটাই এক সূত্রে বাঁধা। বরং সাম্প্রতিক ইউজিসি’র চেয়ারম্যানের এই পদক্ষেপে আরও স্পষ্ট হয়েছে, কীভাবে সাংবিধানিক রীতি রেওয়াজের তোয়াক্কা না করেই সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করতে চাইছে বিজেপি।


উপসংহারের খোঁজে 


ফ্যাসিবাদী  শক্তিগুলি চিরকালই ইতিহাসকে নিজেদের পছন্দমত গড়ে পিটে নিতে চেয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাস গবেষণায় উঠে এসেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার কিভাবে একটি মিথ্যে ভাষ্যকে সত্যি বলে চালাতে চেষ্টা করেছিলেন। ফ্রান্স দখল করার পরে, সেখানকার জার্মান সৈনিকদের একটি লিখিত নির্দেশ পাঠান ফিল্ড মার্শাল উইলহেলম কেইটেল। ১৯৪০ সালের ১২ আগস্ট পাঠানো সেই চিঠিতে জার্মান সৈনিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়, তাঁদের দখলে থাকা ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের সমস্ত স্মৃতিসৌধ নষ্ট করে দেওয়ার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয়। হিটলার মনে করতেন সেই যুদ্ধে প্রাণ হারানো অ্যাংলো ফ্রেঞ্চ সৈনিকদের স্মৃতিসৌধগুলি প্রতি মুহূর্তে জার্মান শৌর্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। সেই কারণেই সৌধগুলি ধ্বংস করার অর্ডার এসেছিল। হিটলারের মতোই, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতিও দাঁড়িয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরাকে অস্বীকার করার উপরে। 
ফ্যাসিবাদী রাজনীতি বেঁচে থাকে বিভেদের উপর ভর করে। নিজের পচা গলা কাঠামোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রতি মুহূর্তে ‘আদার’ বা শত্রুর খোঁজ করে থাকে সে। ইতিহাস সাক্ষী, ফ্যাসিবাদী সমাজ এবং অর্থনীতি খুব তাড়াতাড়ি পতনের মুখে পড়ে। সেই দিক থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে এই কাল্পনিক শত্রু খুঁজে বেড়াতে হয় ফ্যাসিবাদকে। এই শত্রু কখনো ইহুদি কখনো প্যালেস্তিনীয় আবার কখনো ভারতীয় মুসলমান। ফ্যাসিবাদ বেঁচে থাকে কাল্পনিক ইতিহাস নির্মাণের উপরে। যেমনভাবে জায়নবাদী ইজরায়েল বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের পৌরাণিকতাকে হাতিয়ার করে প্যালেস্তাইনে দখলদারি চালাচ্ছে, দাবি করছে ৩ হাজার বছর আগে এটাই ছিল তাদের পিতৃভূমি। এর নেপথ্যে কোনও যুক্তিবোধ বা ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকুক আর না থাকুক, রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসকে হাতিয়ার করেই প্রতিমুহূর্তে সেখানে বসবাসকারী আরবদের বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে যারা কিনা প্রকৃত অর্থেই সেখানকার ভূমিপুত্র। একই কায়দায় ভারতবর্ষেও ভারতীয় এবং অ-ভারতীয় তত্ত্ব হাজির করা হচ্ছে। 
সারা বিশ্বের ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির দেখানো পথে হেঁটে চেতনায় আক্রমণ করে কালেক্টিভ মেমারি বা যৌথ সামাজিক স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। ইউজিসি’র পাঠানো সাম্প্রতিক সার্কুলার তার একটি ছোট্ট অথচ কর্কশ উদাহরণ। স্মৃতিচিহ্নও বটে!
 

Comments :0

Login to leave a comment