একটানা ১৩ বছর কলকাতা কর্পোরেশনের দায়িত্বে থাকলেও এখনও গোটা শহরে পরিশ্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে পারেনি তৃণমূল। সাধারণ মানুষের ভরসা কোথাও কর্পোরেশনের জলের গাড়ি, আবার কোথাও গভীর নলকূপ। একইসঙ্গে বেআইনি নির্মাণের জন্যেও তৈরি হয়েছে জলের সঙ্কট।
বিরোধীদের অভিযোগ, শহরের জলকষ্ট মেটানোর বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট নীল নকশা নেই তৃণমূলের। একইসঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক প্রতি হিংসা। তারফলে বিরোধীরা যেই ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন, সেই ওয়ার্ডগুলির প্রতি বঞ্চনার পরিমাণ আকাশ ছোঁয়া।
সরশুনা অঞ্চলের ১২৭ নম্বর ওয়ার্ড। ২০১৫’র নির্বাচনে এই ওয়ার্ডে জয়ী হন সিপিআই(এম) প্রার্থী নিহার ভক্ত। মূলত তাঁর উদ্যোগেই শকুন্তলা পার্কে একটি বুস্টার পাম্পিং স্টেশন গড়ার কাজ শুরু হয়। এই বুস্টার পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে ৩ লক্ষ গ্যালন পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা সম্ভব। ২০১৯ সালে এই পাম্পিং স্টেশনের কাজ শেষ হলেও এখনও সেটির উদ্বোধন হয় নি।
এই ওয়ার্ডের প্রাক্তন সিপিআই(এম) কাউন্সিলর নিহার ভক্ত জানিয়েছেন, স্রেফ রাজনৈতিক প্রতি হিংসা থেকে বিরোধী কাউন্সিলর থাকা ওয়ার্ডকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই পাম্পিং স্টেশন চালু হলে ১২৭’র পাশাপাশি ১২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েক হাজার মানুষও উপকৃত হতেন। কিন্তু ২০১৫’র নির্বাচনে দুই ওয়ার্ড থেকেই বামপন্থীরা জয়ী হওয়ায় তৃণমূল পাম্পিং স্টেশনের কাজ আটকে রেখেছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিস্তীর্ণ এলাকায় রয়েছে তীব্র জলকষ্ট। অগত্যা ভরসা সেই গভীর নলকূপ। কর্পোরেশনের জলের গাড়ি এলেও তা অনিয়মিত এবং অপ্রতূল।
নিহার ভক্ত জানান, গভীর নলকূপের জল পান করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। প্রায় সমস্ত টিউব ওয়েল দীর্ঘদিনের পুরনো। কিন্তু বাধ্য হয়ে মানুষ সেগুলিকেই ব্যবহার করছেন। যে কোনওদিন এর থেকে বড় সড় বিপদ ঘটতে পারে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পানীয় জলের প্রশ্নে স্থানীয় তৃণমূলী পৌর প্রতিনিধির কাছে একাধিক বার দরবার করা হলেও কোনও লাভ হয়নি।
কেবল বেহালা নয়। যাদবপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও রয়েছে তীব্র জলকষ্ট। কলকাতা কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারদের একটা অংশ জানাচ্ছেন, ৯৮, ৯৯, ১০০, ১০১ সহ বহু ওয়ার্ডে রয়েছে পানীয় জলের সঙ্কট। ধাপা ও ইএম বাইপাস সংলগ্ন এলাকাগুলিতেও রয়েছে তীব্র জলকষ্ট। সংযুক্ত এলাকার বহু জায়গায় এখনও পরিশ্রুত পানীয় জলের সংযোগ পৌঁছে দেওয়া যায় নি। গরমকালে সেই সঙ্কট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
কলকাতায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া নবীন তম জনপদ হল জোকা। জোকা-১ এবং জোকা-২ পঞ্চায়েতকে কলকাতা কর্পোরেশনের ১৪২, ১৪৩ এবং ১৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের রূপ দেওয়া হয়েছে। নামে কলকাতা হলেও এই তিনটি ওয়ার্ডে নাগরিক পরিষেবার ছিঁটেফোঁটা নেই। পানীয় জলের জন্য এখনও এলাকাবাসীর ভরসা গভীর নলকূপ। পানীয় জলের পাশাপাশি রয়েছে আলো এবং নিকাশির সমস্যা।
ওয়াকিবহাল মহলের অভিযোগ, কলকাতার সংযুক্ত এলাকার উন্নয়নের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ করত বামফ্রন্ট পরিচালিত কর্পোরেশন। ২০২৩’র কর্পোরেশন বাজেটে সেই বরাদ্দ তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন কর্পোরেশনের মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তাঁর যুক্তি ছিল, সংযুক্ত এলাকা এখন মূল শহরের সমান উন্নত। তাই বাড়তি তহবিল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যদিও বাস্তবিক অভিজ্ঞতা বলছে তহবিল তুলে দেওয়ার ফলে কলকাতার ভৌগলিক সীমানার মধ্যে থাকা বিস্তীর্ণ অংশের উন্নয়নে দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে।
যদিও সংযুক্ত এলাকার পাশাপাশি বেলেঘাটা তেও রয়েছে পানীয় জলের সঙ্কট। অভিযোগ, এর নেপথ্যে রয়েছে অবৈধ নির্মাণের রমরমা।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, বছর দশেক আগে, ৩৩ ৩৪ এবং ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের জল কষ্ট দূর করতে বেলেঘাটা খালপাড়ে একটি বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরির উদ্যোগ নেন তৎকালীন সিপিআই(এম) কাউন্সিলর রাজীব বিশ্বাস। ওই পাম্পের মাধ্যমে ২৫ বছরের জন্য বেলেঘাটার জল কষ্ট দূর করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু বেআইনি নির্মাণের ফলে সেই পরিকল্পনা অকেজো হয়ে গিয়েছে। তার কারণ, প্রতিটি বেআইনি নির্মাণ থেকেই পাম্পের মাধ্যমে কর্পোরেশনের জলের লাইন থেকে জল চুরি করা হচ্ছে।
তার ফলে সাধারণ মানুষ জল পাচ্ছেন না। তাঁদের ভরসা জলের গাড়ি। অবস্থা সামাল দিতে কর্পোরেশনকে শোপান মাঠে শিশুদের উদ্যান নষ্ট করে আরেকটি বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরি করার কথা ভাবতে হচ্ছে।
Comments :0