প্রবীর দাস- সন্দেশখালি
থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ শেখ শাহজাহান শিবু হাজরা উত্তম সর্দারের কাছে পাঠিয়ে দিত। অন্ধকার নামলে শুরু হতো শেখ শাহজাহানের অত্যাচার। বৃহস্পতিবার এমনই অভিযোগ করলেন সন্দেশখালিতে বিক্ষোভকারী মানুষনজন। ভয় ভেঙেছে সন্দেশখালির। প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছু হটছে তৃণমূল। পুলিশ প্রশাসনের উপর কোন ভরসা নেই সন্দেশখালির মানুষের। তাই অত্যাচার অবিচার বঞ্চনার প্রতিবাদে প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে দেয় জমির আলপথ থেকে প্রতিটি জনপদে। বুধবারের রাতের পর পর বৃহস্পতিবারের ছবিটা প্রতিরোধের শুরুর ইঙ্গিত দিলেও তা আগামীদিনে গোটা সন্দেশখালি জুড়ে প্রতিরোধের এই বার্তা ছড়িয়ে পড়বে তা বলাই বাহুল্য। ফলে আরও বড়ো বিপাকে পড়তে চলেছে রাজ্যের শাসকদল। বৃহস্পতিবার সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে প্রতিরোধের উত্তাপ দফায় দফায় বাড়তে থাকে। শ'য়ে শ'য়ে মহিলারা ঘর গেরস্থালি ফেলে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ দেখাতে শুরু করে। এমন ছবি সন্দেশখালি আগে কখনও দেখেনি। পুলিশ প্রশাসনের মদতে দাসের রাজত্বে পরিণত করে মুখ্যমন্ত্রী ও তার ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির স্নেহধন্য সন্দেশখালির তৃণমূলের বাহুবলী নেতা তৃণমূলের শেখ শাহজাহান।
বুধবারের পর বৃহস্পতিবার আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে সন্দেশখালির আন্দোলনের উত্তাপ। এস ডি পি ও থানার ওসির চোখে চোখ রেখে আন্দোলনকারী মহিলারা আঙ্গুল উঁচিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যতক্ষণনা শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার ও লাল্টু ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ততক্ষণ আমরা কেউ বাড়ি যাব না। আমরা আমাদের হক ফিরে পেতে চাই। আমরাই শেখ শাহজাহান শিবু হাজরা উত্তম সর্দারের নেতা বানিয়ে আমারাই আজ বঞ্চিত। আমাদের ঘরের ছেলেদের জোর করে রাজনীতিতে নামিয়ে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র মদের বোতল তুলে দিয়েছে। তাদের বাবা মায়েরা মিছিলে মিটিং এ না গেলে ঘরের ওই সমস্ত ছেলেদের দিয়ে মারধর করে। তৃণমূলের পার্টি অফিসে মহিলাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে। স্বামীদের কোদালের বাট দিয়ে পালিস করা হয়। আমাদের ঘরের ছেলেদের দিয়ে অন্যের ঘর ভাঙতে মারধর করতে পাঠানো হয়। কতবার থানায় জানাতে এসেছি। থানা থেকে শেখ শাহজাহান শিবু হাজরা উত্তম সর্দারের কাছে পাঠিয়ে দিত। অন্ধকার নামলে শুরু হতো শেখ শাহজাহানের অত্যাচার। শেখ শাহজাহান হুমকি দিত তার কথা না শুনলে গ্রামে বুনো ষাড় ছেড়ে দেওয়া হবে। এতটাই নির্মম ঘোষণা করতো শেখ শাহজাহান।
গত ৩১ জানুয়ারি থেকে পেত্নীঘোলা কর্ণখালির হা-অন্ন প্রান্তিক মানুষ তাদের জমি ফেরত চেয়ে, সরকারি খাল ব্যবহারের অধিকার চেয়ে, হেঁশেল, স্বামী সন্তানদের নিয়ে শান্তিতে বসবাস করার দাবি নিয়ে পথে নেমে আন্দোলন শুরু করে। তাদের অভিযোগ সন্দেশখালির তৃণমূলের বাহুবলী নেতা শেখ শাহজাহান, জেলা পরিষদ সদস্য শিবুপ্রসাদ হাজরা, উত্তম সর্দার, লাল্টু ঘোষরা তাদের জমি দখল করে মেছো ঘেরি বানিয়ে বছরের পর বছর লিজের টাকা দেয় না। রাস্তা কেটে নদীর নোনা জল ঢুকিয়ে চাষযোগ্য জমি মেছোঘেরিতে পরিণত করেছে। তারা তাদের জমির অধিকার ফিরে পেতে আন্দোলন শুরু করে শান্তিপূর্ণভাবে। সেই আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে সন্দেশখালি থানার মদতে গ্রামবাসীদের উপর আক্রমণের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার এবং লাল্টু ঘোষরা।
মঙ্গলবার থেকে সন্দেশখালি থানার অদূরে ত্রিমোহনীতে সভা করে তৃণমূল। সভা শেষে রাতে অন্ধকারে সন্দেশখালি -২নং বিডিও অফিস সংলগ্ন তৃণমূলের পার্টি অফিসে বসে নীল নকশা তৈরি করা হয় বুধবার মিছিল করে পেত্নীঘোলা কর্ণখালির আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালানো হবে। এই খবর গ্রামে গ্রামে রটে যেতেই ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধের বার্তা। লাঠি ঝাটা হাতা খুন্তি নিয়ে বিশেষত মহিলারা নেমে পড়ে রাস্তায়। ওদিকে তখন তুষখালী, জেলিয়াখালি, দাউদপুর, খুলনা, হাটগাছা থেকে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা মিছিলে যোগ দিতে সন্দেশখালি ফেরিঘাটে এলে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। পুলিশের উপস্থিতিতে গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে ছোড়া হয় কাঁচের বোতল। রক্তাক্ত হয় শম্ভু সিংহ সহ কয়েকজন সাধারণ মানুষ। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। প্রতিরোধের উত্তাপ মূহুর্তে বেড়ে যায়। শুরু হয় ধুন্ধুমার কান্ড। বিপদ বুঝে পুলিশের সাহায্যে পুলিশের লঞ্চ ,যন্ত্রচালিত নৌকায় চেপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় বহিরাগত দুষ্কৃতীরা। জলে পড়েও যায় কয়েকজন। এরপর সন্দেশখালি থানা ঘেরাও করে শুরু হয় বিক্ষোভ। আন্দোলনকারীদের দাবি শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার, লাল্টু ঘোষকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশের র্যা পিড অ্যাকশন ফোর্স সহ বিশাল পুলিশ বাহিনী। বন্ধ হয়ে যায় ধামাখালি সন্দেশখালি ফেরি চলাচল, দোকানপাট। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে কৃষ্ঞপ্রসাদ লাইয়া আহত হয়। তার মাথা ফেটে যায়। আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। শুরু সন্দেখালি থানা ঘিরে বিক্ষোভ। তারা দাবি করতে থাকে এখুনি শেখ শাহজাহান, উত্তম সর্দার ও শিবু হাজরা ও লাল্টু ঘোষকে গ্রেপ্তার করতে হবে। শেষমেশ আন্দোলনকারীদের চাপে উত্তম সর্দার সহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বাকিদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে আন্দোলনকারীদের শান্ত করে পুলিশ। যে যার মতো বাড়ি ফিরে যায়।
রাতে উত্তম সর্দারের বাড়ি শিবু হাজরার পোল্ট্রি ঘরে ভাঙচুর চলে, মেছো ঘেরির আলাঘর আগুনে দাউদাউ করে পুঁড়তে থাকে। বৃহস্পতিবার সকাল হতেই প্রচার শুরু হয় আন্দোলনকারীরা এই হামলা, অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে। অভিযোগ নসাৎ করে আন্দোলনকারীরা। তাদের বক্তব্য আমরা হকের দাবিতে আন্দোলন করছি। কেন আমরা ভাঙচুর করবো?
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার সকালে যখন সাধারণ মানুষ জানতে পারে পুলিশের বয়ান অনুযায়ী উত্তম সর্দারকে গ্রেফতার না করে গ্রেফতার করা হয়েছে , ভরত দাস ও পালান সরদারকে। তৃণমূল কর্মী ভরত দাসের দাদা বললেন ভরত ঘটনার সময় বাড়িতেই ছিল। সকালে পুলিশ মারতে মারতে নিয়ে গেল। এরপর ভরত দাস ও পালান অধিকারীদের আদালতে পাঠানো হয়। উত্তম সর্দারকে পুলিশ গ্রেফতার করে নি। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ফের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীরা। লাঠি ঝাটা গাছের ডাল যে যা হাতের সামনে পেয়েছে তাই নিয়ে মহিলা পুরুষ এসে জমা হয় সন্দেশখালি থানা ত্রিমোহনী সহ সর্বত্র। তারা প্রতিবাদ মিছিল শুরু করে। বিডিও অফিস সংলগ্ন তৃণমূলের পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালানো হয়। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য এতদিন ওরা আমাদের পালিশ করেছে। আজ আমরা ওদের পালিশ করবো।
Comments :0