বই
আনোয়ারা সৈয়দ হকের : জীবনের দুর্বিনীত মেয়ের কবিতা
শারণ্য সেন
মুক্তধারা
আনোয়ারা সৈয়দ হকের কবিতাগুলো প্রথমত দারুণ কবিতা! দ্বিতীয়ত চূড়ান্ত আধুনিক কবিতা যেখানে ভাবালুতার জায়গা কম। যা সংযত, মননশীল এবং আবেগের রাশ টেনে ধরার জন্যে যথেষ্ট মজবুত। তৃতীয়ত, এ সকল বৈশিষ্ট্য এবং নির্ধারিত বিষয়ের কারণে কবিতাগুলো নারীবাদী কবিতার অভিধা পায়। এই ধারাটি কবিতার ইতিহাসে একটি বিশেষ জায়গার দাবী রাখে অবশ্যই। তবে এসব পরের বিষয়। আগে পাঠকেরা দারুণ শক্তিশালী কিছু কবিতার সাথে পরিচিত হবেন, সেটি নিশ্চিন্তে বলা যায়। এবং সেটিই সবচাইতে জরুরি। কবিতাকে দাঁড়াতে হয় মূলত কবিতার গুণেই।
এত নিপীড়ন, অসহযোগিতার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নারীর প্রেমের অনুভব ও বেদনার দিনলিপিও নিবিড় পরিচর্যায় আনোয়ারা সৈয়দ হকের কলমে মূর্ত হয়েছে। বিশুদ্ধ অক্ষরবৃত্তে কবি গাইছেন—
সে কোন ছেলেবেলায় তুমি এসে দিয়েছিলে ডাক
অবোধ বালিকা আমি ছুটে এসে দাঁড়ালাম কাছে
কোঁচড় ভরিয়ে দিলে ফুলের সুবাসে
সে কথা গোপন আছে আজীবন গোপনই তা থাক।
আনোয়ারা সৈয়দ হকের এই বইটির কবিতা একই সাথে গভীর এবং উচ্চকিত। বিষয়ের প্রয়োজনে কখনো গলা চড়াচ্ছেন, আবার গভীর বোধের জায়গায় মন্দ্রস্বরে বেদনার্ত গানটি শুনিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতুএই কবিতাগ্রন্থটি বিশেষ পাঠকশ্রেণির জন্যে উৎসর্গ করেছেন, তাই বেদনার চেয়ে বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস, তার পুনর্পাঠ এবং তার ক্ষমতাজাল থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যয়ে কবিতার কণ্ঠস্বরকে বলীয়ান করেছেন কবি।
মেয়ে হয়েছি বেশ করেছি কবিতাগ্রন্থটি পাঠে পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে ২০১১-য় প্রকাশিত কবি আনোয়ারা সৈয়দ হকের আত্মজীবনী ক্ষুব্ধ সংলাপ-এর কথা। নিজ জীবনে শৈশবে কৈশোরে তারুণ্যে ঘটে যাওয়া বঞ্চনা ও নিপীড়নের ইতিহাসের সাথে এই কবিতাগ্রন্থটির বিষয় সাজুয্যের দিকটি অনভিপ্রেত মনে হবার কারণ নেই। নিজের জনক-জননীর উদ্দেশ্যে লিখিত কবিতাটি পাঠ করলে ক্ষুব্ধ সংলাপের ধারাবাহিকতার কথা মনে হতে পারে পাঠকের। কী অপরিসীম বেদনার অনুভূতি নিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখছেন—
এ পৃথিবী ছেড়ে গেছো কত দিন আগে
আবার কি সাজিয়েছো দাসীর সংসার
স্বপ্নগুটি খুলে নিয়ে সাজিয়েছো সোনার নাটাই
শান্তিবেড়া দিয়ে ঘেরা আঙিনায়
আকাশের ওপারের মা আমার আজও হাহাকার?
আশা করি ভালো আছো, মা (২০০১)
ক্ষুব্ধ সংলাপ বইটিতে আনোয়ারা সৈয়দ হক নির্বিকার ও অনায়াস ভঙ্গিতে জীবনের বৈরীতা ও তার লড়াইয়ের অমীমাংসিত গল্প বলেন। গল্পের পরেও যেন উত্তর বাকি থাকা প্রশ্নমালা একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। কখনো পাঠকের দিকে। কখনো স্বয়ং লেখকের দিকে। মেয়ে হয়েছি বেশ করেছি কবিতাগ্রন্থের কবিতাগুলো যেন সেই অপলক নির্বাক দৃষ্টির বিপরীতের শাণিত উত্তর।
Comments :0