গুজরাটে একটানা সাতবার বিধানসভা ভোটে জয় পেল বিজেপি। এবারের নির্বাচনে গুজরাটে বিজেপি’র জয় নিয়ে সংশয় কোনও মহলেই ছিল না। বিরোধীরাও বিজেপি’র জয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল। নতুনত্ব বলতে রেকর্ড সংখ্যক আসন পেয়ে বিজেপি জয় পেয়েছে। এই জয়কেই এদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাজের সাফল্যের প্রতি জনাদেশ বলে জোরালো প্রচার শুরু করেছে বিজেপি। রেকর্ড জয়ের কৃতিত্ব কোনোভাবেই মোদীর হাত ছাড়া করতে রাজি নয় দল।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, এদিন সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে দলীয় সমাবেশে খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নরেন্দ্র তো নির্বাচনে পুরো শক্তি লাগিয়ে দিয়েছিল, যাতে ভূপেন্দ্র জয়ের সমস্ত রেকর্ড ভাঙতে পারে’ !
তিনটি নির্বাচনের ফলপ্রকাশ হয়েছে দুই দিনের মধ্যে। দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এবং হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা ভোটে পরাস্ত হয়েছে বিজেপি। দুটিই তাদের হাতে ছিল। শুধুমাত্র গুজরাটে জয় এসেছে। সেটাকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাফল্য হিসাবে তুলে ধরতে এদিন ফলপ্রকাশের শুরু থেকেই প্রচার চলেছে।
অথচ হিমাচল প্রদেশ এমনকি দিল্লির পৌর নির্বাচনেও মোদীকে ‘মুখ’ বানিয়েই লড়াই করা হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার ভোটগণনার শুরু থেকেই গুজরাটে বিজেপি বিপুল ব্যবধানে এগতে থাকে। বিপরীতে স্পষ্ট হতে থাকে কংগ্রেসের অবস্থা শোচনীয় হতে চলেছে। আম আদমি পার্টি ভোটপ্রচারে প্রবল হইচই শুরু করলেও বাস্তবে তেমন কিছু করতে পারেনি। ১৮২ আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছে ১৫৬ আসনে। কংগ্রেস ১৭টি, আম আদমি পার্টি ৫টি, সমাজবাদী পার্টি ১টি এবং নির্দলরা ৩টি আসনে জয় পেয়েছে। এর আগে ১৯৮৫ সালে মাধবসিং সোলাঙ্কির নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৪৯টি আসনে জয় পেয়েছিল। এতদিন সেটাই গুজরাট বিধানসভায় সবথেকে বড় জয় ছিল। ‘গুজরাট মডেল’, ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ ইত্যাদি প্রচারের পরেও সেই জয়ের ধারে কাছেও অতীতে কখনও বিজেপি যেতে পারেনি। ফলে এবারের ‘রেকর্ড’ জয়কে যে কোনও প্রকারেই ‘মোদীর জয়’ হিসাবে দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি।
গুজরাটে ভোটে দলের সাফল্যকে মোদীর নেতৃত্বের জয় হিসাবেই এদিন তুলে ধরেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা। মোদীজীর নেতৃত্বে গত দুই দশকে গুজরাট উন্নয়নের নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে বলে টুইট করেছেন অমিত শাহ। সঙ্গে জুড়েছেন গুজরাটের মানুষ ‘তোষণের’ নীতিকে খারিজ করেছেন। নাড্ডাও টুইটে লিখেছেন, গুজরাটে দলের ঐতিহাসিক জয় উন্নয়নের প্রতি মোদীর দায়বদ্ধতা, জনকল্যাণ এবং যোগ্য প্রশাসন চালানোর জন্যেই সম্ভব হয়েছে। যদিও নাড্ডা বললেনি, তাহলে হিমাচলের পরাজয়ের দায় কার।
গুজরাটের ভোট কতটা একতরফা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা শূন্য হয়েছে তার প্রমাণ মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেলের জয়ের ব্যবধান। প্রায় ২ লক্ষ ভোটে জয় পেয়েছেন প্যাটেল! শতকরা ৮২ ভাগের বেশি ভোট পেয়েছেন ভূপেন্দ্র প্যাটেল। একটি বিধানসভা কেন্দ্রে ২ লক্ষ ভোটে জয় প্রসঙ্গে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদী। দলীয় কর্মী সমাবেশে বলেছেন, লোকসভা ভোটেও অনেক কেন্দ্রে এত ব্যবধানে জয় পাওয়া যায় না। প্যাটেলই গুজরাটের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। সোমবার নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন তিনি, জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছরে বিজেপি বারে বারে মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তন করেছে গুজরাটে। শেষ পর্যন্ত ‘প্যাটেল’ মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে।
গতবার পাতিদার আন্দোলনের জেরে টলে গিয়েছিল বিজেপি’র গদি। সেই আন্দোলনের অন্যতম মুখ হার্দিক প্যাটেলকে আগেই দলে টেনেছেন মোদী-শাহরা। তফসিলি নেতা আল্পেশ ঠাকোরও বিজেপিতেই। গত বিধানসভা ভোটে তিন যুব নেতা জিগনেশ মেওয়ানি, আল্পেশ ঠাকোর এবং হার্দিক প্যাটেলকে সঙ্গে নিয়ে রাহুল গান্ধী বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিলেন মোদী-শাহকে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে আসন সংখ্যা কমে কোনোক্রমে সরকার রক্ষা করেছিল বিজেপি।
এবার তাঁদের দুই জন বিজেপি’তে। কংগ্রেসের সঙ্গে থেকে এই দুর্দিনেও নিজের আসন বের করেছেন জিগনেশ মেওয়ানি।
এবার অনেক আগে থেকেই লড়াইতেই নেই কংগ্রেস। দলের শীর্ষে তুমুল অন্তর্কলহ তার অন্যতম কারণ। গত নির্বাচনে গুজরাটে ‘মুখ’ হয়ে রাহুল গান্ধীও দূরেই থেকেছেন নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে। পাশাপাশি, নানাভাবে বিজেপি কংগ্রেসের সঙ্গে থাকা জাতপাতভিত্তিক প্রভাবশালীদের টেনে নিয়েছে নিজেদের দিকে। দুর্বল কংগ্রেসের পক্ষে তা আটকানোর কোনও চেষ্টাও হয়নি। কংগ্রেসের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে আম আদমি পার্টিও। গুজরাটে বিজেপি বিরোধী মানুষের মঞ্চ হয়ে ওঠার চেষ্টার সুযোগ নিতে কোনও খামতি রাখেননি কেজরিওয়ালরা।
যথেচ্ছ পালটা হিন্দুত্বের তাসও খেলেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। বিশ্লেষকদের মতে, এরফলে আরও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বিজেপি বিরোধী ভোটারদের মধ্যে। বিজেপি’কে রুখতে কাকে ভোট দেওয়া প্রয়োজন, সেই হিসাব গেছে গুলিয়ে। যাতে আখেরে বিজেপি’রই লাভ হয়েছে বলে মত তাঁদের।
এরপরেও বিন্দুমাত্র আত্মসন্তুষ্টি না রেখে গুজরাট দখলে কোনও খামতি রাখেননি মোদী-শাহরা। মহারাষ্ট্র সহ একাধিক রাজ্যের শিল্প প্রকল্প নিয়ে গেছেন গুজরাটে। এদিন সেই খোঁচাও দিয়েছেন উদ্ধব থ্যাকারে। গুজরাট জয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, মহারাষ্ট্র থেকে শিল্প প্রকল্প গুজরাটে নিয়ে যাওয়াও এই জয়ে সাহায্য করেছে! একইসঙ্গে বেলাগাম সাম্প্রদায়িক জিগির ছড়ানো হয়েছে। খোদ অমিত শাহ ২০০২ সালের ‘শিক্ষা দেওয়া’র উল্লেখ করেছেন। বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের স্বাধীনতা দিবসের দিন ‘মুক্তি’ দিয়ে ‘হিন্দুত্বে’র বার্তা দেওয়া হয়েছে। তাকে সমর্থনকারী সি কে রাউলজিকেই গোধরা কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়েছে। ভোটের ফলপ্রকাশের পরে যে অমিত শাহ, জে পি নাড্ডারা উন্নয়নের জয় দেখাচ্ছেন, তাঁরাই গোটা ভোট প্রচারে ২০০২ সালের স্মৃতিকে উসকে ভোট চেয়েছেন।
নাগরিকত্ব, ধর্মান্তরকরণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি- কিছুই বাকি রাখেনি বিজেপি। এমনকি শ্রদ্ধা-আফতাবের ঘটনাকে গুজরাটের গলি-মহল্লায় প্রচার করা হয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা গুজরাটে প্রচারে বলেন , যদি দেশে নরেন্দ্র মোদীর মতো সর্বশক্তিমান নেতা না থাকতেন, তাহলে গোটা দেশেই আফতাবরা জন্ম নিত!
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে দলীয় সমাবেশে মোদী দলীয় কর্মীদের বলেছেন, এরপরেও আমি আক্রান্ত হবো। ২০০২ সালের পরে আমার জীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র ছিল না, যা তছনছ করা হয়নি। জয়ের কারণ হিসাবে ‘উন্নয়ন’-এর কথা বলা হলেও মোদী-শাহরা গুজরাটে ভোট সাফল্যের আসল রহস্য জানেন।
Comments :0