Editorial

মিথ্যার সওদাগর

সম্পাদকীয় বিভাগ

সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাকালে শাসক দলের জনৈক সাংসদ সিপিআই(এম) এবং তার প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদককে দেশদ্রোহী বলে গালি দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। কোনও নথি প্রমাণ ছাড়া কিসের ভিত্তিতে তিনি এমন বালখিল্যপনা সংসদে দাঁড়িয়ে করেছেন তার কোনও ব্যাখ্যা দেননি। শুধু হাওয়ায় ভা‍‌সিয়ে দিয়েছেন তাঁর কাছে নাকি হাজার হাজার মেল এসেছে যেখানে তাঁর বক্তব্যের প্রমাণ আছে। অবশ্য প্রমাণ হাজির করার সৎসাহস তাঁর হয়নি। সম্ভবত অভিযোগ প্রমাণের কোনও তথ্যই তাঁর কাছে নেই। দায়িত্বজ্ঞানহীন মিথ্যার ব্যাপারীরা এমনই করে থাকে। একটা মিথ্যাকে আড়াল করতে আর এক মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তারপর পালিয়ে বেড়ায়। আসলে যাদের রাজনীতি ও মতাদর্শ যুক্তিহীন মিথ্যা অবাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে তারা যে এমন মিথ্যা ও কুৎসার আশ্রয় নেবে সেটাই স্বাভাবিক। আরএসএস-বিজেপি’র কাছে এর চেয়ে উত্তম কিছু প্রত্যাশা করা বৃথা।

স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে যাদের টিকিও খুঁজে পাওয়া যায়নি, উলটে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের হয়ে যারা দালালি করেছে, এমনকি সর্বত্যাগী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সুযোগ বুঝে পেছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা করেছে আজ ক্ষমতার দণ্ড হাতে নিয়ে তারা দেশপ্রেমের মাতব্বর হয়েছেন। ভণ্ড সন্যাসীর মতো দেশপ্রেমের বাণী বিতরণ করছেন। যে বামপন্থী তথা কমিউনিস্টরা সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য, সর্বোপরি ভারতের জনগণের মধ্যে যেকোনও ধরনের বিভাজনের বিরুদ্ধে ঐক্য ও সংহতির জন্য বুক চিতিয়ে আত্মবলিদানে এগিয়ে গিয়েছে আজ তাদের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে মুচলেকা দেওয়া ভণ্ড দেশপ্রেমিকের ভক্তরা। বামপন্থীদের দেশপ্রেমের গভীরতা মাপার যোগ্যতাই যাদের নেই অজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে নির্বোধের মতো তারা সন্দেহ প্রকাশ করছে দেশের প্রতি বামপন্থীদের ভালোবাসা নিয়ে। উগ্র দেশপ্রেমের কারবারি এবং বিদ্বেষ-ঘৃণা-হিংসার সওদাগরদের পক্ষে এমনটাই করার কথা। এই ভণ্ড, খণ্ড ও কূপমণ্ডুক দেশপ্রেমীদের জেনে রাখা ভালো বামপন্থীরা শুধু স্বদেশপ্রেমিকই নয়, একাধারে বিশ্ব মানবতারও সমান সমর্থক। বামপন্থীরা তাদের দেশবাসীকে ধর্মের পরিচয়ে বা জাতের পরিচয়ে বিচার করে না। তাদের সকলের মধ্যেকার মনুষ্যত্বকেই উদ্ভাসিত করে। ধর্ম-বর্ণ-জাত-ভাষা-সংস্কৃতির হাজারো ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে মানুষকে মানুষ হিসাবে চিনতে ও ভাবতে শেখায় বামপন্থা। মানুষের সুকোমল মানবিক বৃত্তিগুলিকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।

আরএসএস-বিজেপি’র মতো ঘৃণার চাষ করে না বামপন্থীরা। ধর্মের নামে, জাতের পরিচয়ে, ভাষার জন্য কাউকে আক্রমণ করতে বা খুন করতে শেখায় না। ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করে, হিংসা ও ঘৃণা ছড়িয়ে যারা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধায়, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন করে যারা ভোটের ফায়দা তুলতে চায় তারা আর যাই হোক দেশপ্রেমী হতে পারে না। দেশপ্রেমের নামে ভণ্ডামি করে। মানুষকে বিভ্রান্ত করে, বিপথে চালিত করে। ক্ষমতা দখলের জন্য কুৎসিত ও কদর্যভাবে মানুষকে ব্যবহার করে। বস্তুত ক্ষমতার লোভে উন্মাদ হয়ে তারা দেশদ্রোহী বলার আগে আয়নায় নিজেদের মুখ ভালো করে দেখে নেওয়া উচিত ছিল। প্রয়োজন ছিল আত্ম বিশ্লেষণের। আসলে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সবচেয়ে জোরালো, সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধিতা যেহেতু সিপিআই(এম)’র দিক থেকেই আসে তাই সিপিআই(এম)’কে ঠেকানোর জন্য এই মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। শাসক সাংসদ প্রমাণ হিসাবে হাজার হাজার মেলের উল্লেখ করেছেন ঠিকই তবে সেই মেল প্রকাশ হলেও তাঁর বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ হবে না। কারণ সেখানে আদৌ কোনও প্রমাণই নেই। বরং এটাই প্রমাণ হয়ে যাবে ‘গণতন্ত্রের মন্দিরে’ দাঁড়িয়ে তিনি ভিত্তিহীন অসত্য ভাষণ দিয়েছেন।

 

Comments :0

Login to leave a comment