বইকথা
রবীন্দ্রনাথের 'সহজপাঠ'--প্রথম ভাগ শিশুশিক্ষার এক উজ্জ্বল স্মারক গ্রন্থ
সৌরভ দত্ত
নতুনপাতা
শিশুশিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ একটি অবিসংবাদী নাম সহজপাঠের প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ।সহজপাঠের প্রথম ভাগের আলোচনা প্রসঙ্গে বলা চলে ভাষাসন্দর্শনের জন্য রবীন্দ্রনাথ বিরচিত এ গ্রন্থখানি শিশুদের বর্ণ পরিচয় ঘটানোর জন্য লিখিত হয়েছে।অনেক সমালোচক প্রাইমার গুলির সাথে একে স্থান দিতে না চাইলেও শিশু সহজপাঠের এক শাশ্বত আবেদন আছে।বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের পরে সহজপাঠের প্রথম ভাগ আবশ্যিক পাঠ্য গ্রন্থ।নন্দলাল বসু কর্তৃক চিত্রার্পিত গ্রন্থটির ছবি রেখা দেখে দেখে অক্ষরজ্ঞান সচেতন হওয়ার লক্ষ্য রেখেই রবীন্দ্রনাথ বইটির খসড়া নির্মাণ করেছিলেন। যদিও গ্রন্থে– য়,ৎ,ড়,ঢ়,ং,ঃ,ঁ প্রভৃতি একাধিক বর্ণের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করাননি।প্রাথমিক ব্যবহারিক পরিবেশ পাঠের লক্ষ্য রেখে সহজপাঠ রচিত হয়েছিল।প্রকৃতি সচেতন কবি বহিঃপ্রকৃতির সৌন্দর্যময়তার সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচিতি ঘটাতে চেয়েছেন।ছন্দ মিল যোজনার ফলে শিশুরা যদি পড়ায় মনোযোগী হয় সে চেষ্টা করেছেন।লিনো কাঠে নির্মিত নন্দলাল বসু প্রথম ছবিটিই শিশু মনস্তত্ত্বে যথেষ্ট ছাপ ফেলে–অ,আ অক্ষর পরিচয় করাতে গিয়ে ছোটোখোকার প্রসঙ্গ এনেছেন।"ছোটো খোকা বলে অ আ/শেখেনি সে কথা কওয়া।আধো আধো বোলে নবসাক্ষর পড়ুয়া যখন এ ছড়া পাঠ করবে তখন তার স্পন্দতান গভীরভাবে অনুরণিত হবে শিশু হৃদয়ে।দুটি হাঁসবা দুটি কুকুরের পরস্পর খুনসুটির ছবি সাথে সাথে হ্রস্বইকার, দীর্ঘঈকার, হ্রস্বউকার, দীর্ঘউকার প্রযুক্ত হয়েছে।কৃত্রিমতাকে এড়িতে জীবজন্তুর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বর্ণপরিচয়।বর্ষণমুখর দিনের মেঘমন্দ্রিত চালচিত্র নির্মিত হয়েছে ছাতার নিচে আশ্রয়রত দুই শিশুর মধ্যে দিয়ে–"ঘন মেঘ বলে ঋ/দিন বড়ো বিশ্রী"।ঘন মেঘের আস্ফালনে ঋ কার এর প্রয়োগ কল্পনার মিশেলে ঘটেছে।মিল অনয়ণের জন্য রবীন্দ্রনাথ একক বর্ণের তালিকায় 'ক্ষ'-কে রেখেছেন।ভেতো বাঙালির পাকশালকেও সহজপাঠে তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ।" ডাক পাড়ে ও ঔ/ভাত আনো বড় বৌ।"গৃহস্থ সংসারে বেলা বাড়লে ভাতের জন্য মানুষের ক্ষৎকাতরতাকে এইভাবে দেখিয়েছেন কবি।সহজপাঠের প্রথম ভাগের প্রথম পাঠে কবি বলেছেন-"বনে থাকে বাঘ/গাছে থাকে পাখি/জলে মাছ থাকে মাছ"--পরিবেশ ভাবনা সজ্ঞাত জীবকূলের বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থান ফুটে ওঠেছে লেখার মধ্যে।ঝলমলে স্বচ্ছ দিঘিজল,কাকেদের কলরব,খুদিরামের জাম পাড়া প্রভৃতি একাধিক অনুষঙ্গ নষ্টালজিক করে তোলে শিশুদের।দ্বিতীয় পাঠে অঙ্কিত হয়েছে– রাম নামক বালকের শীতের সকালে ফুল পাড়ার কথা যে গায়ে লাল শাল জড়িয়ে আছে।হাতে রয়েছে ফুলসাজি। "কালো রাতি গেল ঘুচে/ আলো তারে দিল মুছে"--এ ছড়ার মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তাদর্শের মেলবন্ধন ঘটেছে। আলোর আগমনের সাথে সাথে অন্ধকার দূর হওয়ার ছবি প্রকাশিত হয়েছে।তৃতীয় পাঠে দেখা যায়–"মোষ নিয়ে ফার হয় রাখালের ছেলে/বাঁশে বাঁধা জাল নিয়ে মাছ ধরে জেলে"--গ্রামের রাখাল বালক মোষ চরায়, জেলে মাছ ধরে জীবিকা অর্জন করে। এভাবেই প্রকৃতির সুশ্রী দিকগুলি তুলে ধরেছেন কবি সহজপাঠের পাতায়।বামির মাটি দিয়ে ঘটি মাজার প্রসঙ্গ সে সময়ের সাংসারিক কার্যপ্রণালী ও বাসন-কোসনে মাজতে যে মাটির ব্যবহার বহুল প্রচলিত সেদিকটিকে চিহ্নিত করে।কৌতূহলী শিশু ভাষা খুঁজে পায় সহজপাঠের আন্দোলিত সুরে।চতুর্থ পাঠে পরিবেশিত হয়েছে–"ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি/আছে আমাদের পাড়াখানি"--বর্ণনায় পল্লীর স্বর্গীয় সুষমার সৌন্দর্য মুগ্ধ করে পাঠককে।দিঘি ও চারিদিকে বিন্যস্ত সারিসারি তালবন।নগর সভ্যতার ছাতছানিতে যে ছবি বাংলার বুকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। "আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে "--নদীমাতৃক সভ্যতায় রুদ্র বৈশাখের দাবদাহে রুখাশুখা নদীতে হাঁটুজল দাঁড়িয়ে থাখে।বেলা পড়ে এলে তেল মেখে ডুব দিয়ে আসার কথা উল্লেখিত হয়েছে ষষ্ঠপাঠে।কিংবা "এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে"--শরৎকাল এলেই বেশ শীত শীত লাগে আমাদের।ঘাসের উপর শিশিরের রেখা দেখা যায়।পরিবেশ,প্রকৃতির পটপরিবর্তনকে খুব সুন্দর শৈল্পিক আঙ্গিকে সহজপাঠে জায়মান করে দিয়েছেন কবি।"ভোর হল ধোবা আসে/ঐ তো লোকা ধোবা"--তৎকালীন সময়ে জামাকাপড়ের পরিচর্যার জন্য ধোবা আনাগোনা তখন ছিল।এখন প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ওয়াশিং মেশিন এসেছে।ফলে ধোবারাও গুরুত্ব হারিয়েছে।কল্পনার অতিরিক্ততা থাকলেও সহজপাঠের এক-একটি চরিত্রকে গল্পের নির্যাসে শিশু মনস্তত্ত্বে অনায়াসে জীবন্ত করে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ।ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে সহজপাঠের ছবি ও ছন্দময় কবিতার রূপ-রস অপূর্ব অনুভবময়।
গ্রন্থনাম:সহজপাঠ প্রথম ভাগ
লেখক:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকাশক:শ্রী সুধাংশুশেখর ঘোষ
বিশ্বভারতী।ছয় আচার্য জগদীশ বসু রোড।কলকাতা সতেরো
অলংকরণ:নন্দলাল বসু
প্রথম প্রকাশ :১৩৩৭ বঙ্গাব্দ
Comments :0