Rujira interrogation

অ্যাকাউন্টে কয়লা পাচারের টাকা কেন, প্রশ্ন রুজিরাকে

কলকাতা


 


 নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ৮ জুন—  বেলা বারোটার কিছু পরে কালো কাচ ঢাকা কালো রঙের একটি দামি গাড়িতেই সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে ইডি দপ্তরে হাজিরা দিতে এলেন অভিষেক জায়া রুজিরা ব্যানার্জি!
    যে গাড়িটি করে রুজিরা ব্যানার্জি কয়লা পাচার কাণ্ডে জেরায় হাজিরা দিতে এলেন সেই গাড়িটি বিতর্কিত সেই  ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ সংস্থারই গাড়ি।
    কয়লা পাচার কাণ্ডে এই সংস্থার ভূমিকা, লেনদেন এখন তদন্তের মুখে। কয়লা পাচারের টাকা ঢুকেছিল এই সংস্থায়।
    সেই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেডের গাড়িতেই কয়লা কাণ্ডে মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে হাজিরা দিতে এলেন রুজিরা নারুলা। তাজ্জব তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরাও। তবে, এদিন গত বছর জুন মাসের জেরায় রুজিরাকে কোলে সন্তান নিয়ে সিজিও কমপ্লেক্সে জেরায় হাজিরা দিতে দেখা গেলেও এবার সেরকম কোনও দৃশ্য দেখা যায়নি।
     অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা ব্যানার্জিও একসময় এই সংস্থার বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স-এ ছিলেন। আগে অভিষেক ব্যানার্জি ও কালীঘাটের কাকুও ছিলেন। ২০১৪ সালে তাঁরা ডিরেক্টর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তারপরেই রুজিরা ব্যানার্জি বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স-এ ঢোকেন। বর্তমানে সংস্থার দুই ডিরেক্টর- অভিষেক ব্যানার্জির বাবা ও মা।
    ইডি সূত্রে জানা গেছে, ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’- এই দুই সংস্থায় সন্দেহজনক লেনদেনের হদিশ মিলেছে। একটি নির্মাণকারী সংস্থার মাধ্যমে ঢুকেছে টাকা।  সেই সংস্থার সঙ্গে আবার সরাসরি যোগ কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার। অর্থাৎ কয়লা পাচারের কারবারের টাকাই ঢুকেছিল ঘুরপথে, টাকার পরিমাণ ৪ কোটি ৩৭ লক্ষ।
   যে সংস্থায় কয়লার টাকা খাটার অভিযোগ সেই সংস্থার নামে কেনা এই ‘টয়োটা ফরচুনার সিগমা ফোর ব্র্যান্ড’র গাড়ি চেপেই ইডি দপ্তরে অভিষেকের স্ত্রী। গাড়িটি লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেডের নামে কেনা হয়, ২০১৬ সালে ৯ ডিসেম্বর রেজিস্ট্রি হয়, যার বাজারমূল্য ৩২ থেকে ৩৩লক্ষ টাকা।
     এদিকে, রুজিরাকে জেরার দিনই নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে এবার অভিষেক ব্যানার্জিকে তলবের নোটিশ ধরালো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। আগামী মঙ্গলবার সল্টলেকে ইডি দপ্তরে হাজিরা দেওয়ার জন্য নোটিশ পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রাইমারি নিয়োগ দুর্নীতিতে এই প্রথম ইডির জেরার মুখে পড়তে চলেছেন ভাইপো সাংসদ। বৈভবের ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচির মাঝেই তাঁকে হাজিরা দিতে হবে। ইডি’র হেফাজতেই আপাতত রয়েছেন অভিষেক ঘনিষ্ঠ নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত ‘কালীঘাটের কাকু’।
       বৃহস্পতিবার বেলা বারোটার কিছু পরে সল্টলেকে সিজিও কমপ্লেক্সে ঢোকেন রুজিরা নারুলা। প্রায় চার ঘন্টা পরে জেরা শেষে তিনি বেরিয়ে যান। কয়লা পাচার কাণ্ডে বিদেশে মানি লন্ডারিংয়ের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের এই সদস্যার বিরুদ্ধে। রুজিরা নারুলা ব্যানার্জিকে জেরা করতে এদিন সকালেই ইডির তিন শীর্ষ আধিকারিক কলকাতায় আসেন। এই তদন্তকারী দলে রয়েছেন ইডির ডেপুটি ডিরেক্টর পঙ্কজ কুমার ও দু'জন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদমর্যাদার আধিকারিক। দুপুর বারোটা নাগাদ তাঁরা সল্টলেকে ইডি দপ্তরে আসেন। সেই সময়তেই সিজিও কমপ্লেক্সে আসেন অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রী। তাঁর জেরার জন্য বিধাননগর কমিশনারেটের তরফে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেভাবে আঁটোসাটো করা হয় তাতে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠছে রুজিরা ব্যানার্জি দল বা সরকারের তো কোনও পদে নেই, তাহলে প্রশাসনের এত তৎপরতা কিসের?
       এর আগে সিবিআই-এর দুবার জেরা এবং এদিনের পরে ইডিরও দুবার জেরার মুখে পড়তে হলো রুজিরা নারুলা ব্যানার্জিকে। কিন্তু কেন কয়লা পাচার কাণ্ডে বারেবারে আসছে তাঁর নাম? কেন কয়লা কাণ্ডের তদন্তে কোটি কোটি টাকা পাচারের কারবারে বারেবারে আসছে তাঁর প্রসঙ্গ? ইডির দাবি অভিষেক ব্যানার্জির পরিকল্পনাতেই মানি লন্ডারিংয়ের তাঁর স্ত্রীর বিদেশের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। 
      গত সোমবার দুবাই হয়ে ব্যাঙ্কক যেতে গিয়ে অভিবাসন দপ্তরের বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল রুজিরা নারুলা ব্যানার্জিকে। তাঁর নামে কয়লা পাচার কাণ্ডে ইডির লুক আউট নোটিস জারি থাকায় অভিবাসন দপ্তর তাঁকে আটকে দেয়। পরে ইডির আধিকারিকরা এসে তাঁর হাতে জেরার নোটিসও ধরিয়ে দিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিস জারির ঘটনা এবং বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া নিয়ে মুখ খোলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। 
       এদিন আবার যখন ইডি দপ্তরে তাঁর ভাইপোর স্ত্রীর জেরা চলছে সেই সময়েই নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমার পারিবারিক ব্যাপার। এ নিয়ে আমি কিছু বলব না। ও স্বাধীন মেয়ে, অ্যাডাল্ট মেয়ে, ভাল মেয়ে, শান্ত মেয়ে। ও নিজেরটা নিজেই বলবে।’ মুখ্যমন্ত্রী বলছেন পারিবারিক ব্যাপার। অথচ অভিষেক ব্যানার্জি থেকে তৃণমূলের নেতারা রুজিরাকে তলবের ঘটনা তৃণমূলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বলেই অভিযোগ করছিলেন এতদিন।
       তবে সেই পারিবারিক ব্যাপার নিয়েই বারেবারে মুখ খুলেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। এর আগে রুজিরাকে সিবিআই জেরার ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ঘরের বউকে এখন চোর বলা হচ্ছে! ২০২১ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি বাড়িতে এসেই রুজিরা ব্যানার্জিকে কয়লাকাণ্ডেই জেরা করেছিল সিবিআই। সেদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় জেরার আগেই মুখ্যমন্ত্রী নিজেই অভিষেক ব্যানার্জির বাড়িতে চলে আসেন। মিনিট দশেক থাকেন ভিতরে। তার পাঁচ মিনিট বাদেই আসে সিবিআই’র তদন্তকারী আধিকারিকদের দল। কয়লা পাচারকাণ্ডে যাকে জেরা করবে সিবিআই, পাঁচ মিনিট আগে তাঁর সঙ্গেই কথা বলে যাওয়া যে আসলে তদন্তে প্রভাব ফেলারই চেষ্টা, সেই অভিযোগও ওঠে।
      ইডি’র একটি সূত্রে জানা গেছে আয়কর দপ্তরের সঙ্গে যৌথ তল্লাশি থেকে মেলা নথি এবং ডিজিটাল এভিডেন্স থেকে দেখা যায় ইতিমধ্যে কয়লা পাচার কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া বাঁকুড়া থানার আইসি অশোক মিশ্রের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কে (সিয়াম প্যারাগন ব্রাঞ্চ) রুজিরা নারুলা ব্যানার্জির অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছেছিল। কয়লাকাণ্ডে অশোক মিশ্র ও কয়লাকাণ্ডে বিনয় মিশ্রের মতই ফেরার নীরজ সিংয়ের কথোপকথনের ডিজিটাল প্রমাণ হাতে আসে তদন্তকারী সংস্থার। তাতে দেখা যায় ২০১৮সালে নভেম্বর মাসে অশোক মিশ্রের মাধ্যমে নীরোজ সিং দেড় মিলিয়ন ভাট (থাই কারেন্সি) ট্রান্সফার করে। এই নীরজ সিং কয়লা মাফিয়া লালার হিসাবরক্ষক ছিলেন। এখনও পলাতক। 
      ইডি' র তরফে এদিনের জেরাতেও সেই নথি সামনে রেখেই  রুজিরাকে তাঁর অ্যাকাউন্টের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। কেন তাঁর অ্যাকাউন্টে কয়লা মাফিয়ারা টাকার হদিশ মিলেছে, কী যোগ? বর্তমানে জামিনে থাকা পুলিশ আধিকারিক আবার অভিষেক ঘনিষ্ঠ ফেরার বিনয় মিশ্রের আত্মীয় হন। তাঁর মাধ্যমেই লেনদেন হত বলে ইডি’র অভিযোগ। দিল্লিতে নিম্ন আদালতে চার্জশিটেও তা উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু থাইল্যান্ডের অ্যাকাউন্টে নয়, লন্ডনের বার্কলেজ ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টেও কয়লার টাকা ঢুকেছিল। লালার একাধিক অফিস ও বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মিলেছে নথি যাতে ইঙ্গিত মেলে ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রী রুজিরা নারুলা, শ্যালিকা মেনকা গম্ভীর, শ্যালিকার স্বামী ও শ্বশুরের বিদেশের  অ্যাকাউন্টেও টাকা ঢুকেছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment