ধান্ধার ধনতন্ত্রের হাঁড়িকাঠে বলি হতে চলেছে ভারতের তো বটেই বিশ্বেরও অন্যতম বৃহৎ জীবনবিমা সংস্থা এলআইসি। শুধু লাভজনক নয়, দেশের জীবনবিমা বাজারের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই এলআইসি’র দখলে। উদারনীতির ঝোড়ো হাওয়ায় দেশের জীবনবিমা ক্ষেত্রকে দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হলেও এলআইসি’র গায়ে কেউ আঁচড় কাটতে পারেনি আজও। সারা দেশে কয়েক ডজন বেসরকারি জীবনবিমা সংস্থা ব্যবস্থা করলেও তাদের সকলের মোট গ্রাহকের থেকেও বেশি গ্রাহক এলআইসি’র। সংখ্যা ব্রাজিলের মোট জনসংখ্যার থেকেও বেশি। এহেন একটি সংস্থা যে মোদানি চক্রের টার্গেট তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বাস্তবে হয়েছেও তাই। অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মতো এলআইসি’কেও বেসরকারি কর্পোরেট মালিকদের হাতে জলের দরে তুলে দেবার জন্য ষড়যন্ত্রের যে জাল বুনেছিল মোদানিরা তার ফল ফলতে শুরু করেছে।
ভারতের ধান্ধার ধনতন্ত্রের অন্যতম প্রধান মুখ আদানিদের বিভিন্ন সংস্থায় এলআইসি বিপুল পরিমাণে টাকা ঢেলেছিল প্রধানমন্ত্রীর প্রলম্বিত হাতের ইশারায়। অতি কম মূল্যের শেয়ার কয়েকগুণ বেশি মূল্যে বিক্রি হলে বাজারে সেইসব কোম্পানি সেরার সেরা হয়ে ওঠে। এলআইসি’কে দিয়ে সেই লক্ষ্যেই আদানিদের শেয়ার কেনানো হয়েছিল। তার জেরে আদানিদের সম্পদ ক্ষণকালের মধ্যেই বাড়তে থাকে রকেট গতিতে। দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে গুজরাটের এক পাতি ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থায় সঞ্চিত সাধারণ মানুষের আমানত ব্যবহার করা হয়েছে আদানিদের সম্পদ বেলুনে হাওয়া জোগাতে। মার্কিন সংস্থা হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের ধাক্কায় এখন সেই বেলুন ফুটো হয়ে গেছে। হিন্ডেনবার্গ ভারতবাসীসহ দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছে আদানির উত্থান রহস্য। স্পষ্ট করে দিয়েছে বিদেশি ভুয়া সংস্থার মাধ্যমে টাকা ঢেলে জালিয়াতি করা হয়েছে। হয়েছে অনেক অবৈধ লেনদেন। অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরে এসেছে আদানি সংস্থায় বিদেশি লগ্নি রূপে। তাতে কৃত্রিমভাবে হু হু করে বাড়তে থাকে আদানিদের শেয়ার। সেই অতি বর্ধিত মূল্যে প্রধানমন্ত্রীর ইশারায় শেয়ার কিনতে হয় এলআইসি এবং অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে। অর্থাৎ জনগণের টাকা পাচার করে দেওয়া হলো আদানিদের ঘরে। এক টাকার শেয়ার দশ টাকায় কিনে এলআইসি লোকসান গুনলো। মোদানি চক্রের এই গোপন কাণ্ডকারখানা হিন্ডেনবার্গ ফাঁস করে দেবার পর পতন শুরু হয় আদানির শেয়ার মূল্য। পড়তে পড়তে তা এক তৃতীয়াংশে এসে ঠেকে। পরিণামে আদানি সংস্থায় যাদেরই বড়সড় লগ্নি ছিল তাদেরও শেয়ারে ধস নামতে শুরু করে। এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান দৃষ্টান্ত এলআইসি।
জালিয়াতির মাধ্যমে আদানিদের শেয়ার মূল্য অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়ে সেই বর্ধিত মূল্যে সস্তার শেয়ার এলআইসি’কে দিয়ে কেনানো হলো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আদানিরা লাভবান হলো। আদানিদের স্বার্থে ব্যবহার করা হলো এলআইসি’কে। এখন হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের ধাক্কায় আদানিদের শেয়ার মূল্যে ধস নামার প্রভাব পড়েছে এলআইসি’তেও। যথারীতি কমেছে এলআইসি’র শেয়ারের দাম। গত এক বছরে মূল্য পতন হয়েছে ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছর আগে শেয়ার বাজারে এলআইসি’কে নথিভুক্ত করার সময় মোট শেয়ার মূল্য ছিল ৬ লক্ষ কোটি টাকা। এখন সেটা কমে হয়েছে ৩.৬০ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ এলআইসি’র বাজার দর কমেছে ২.৪০ লক্ষ কোটি টাকা।
কোনও সংস্থার শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে শেয়ার বাজারে তার শেয়ার মূল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেয়ার বাজারে যা দাম হবে সেই দরেই হবে শেয়ার কেনাবেচা। আদানিরা জালিয়াতি করে কৃত্রিমভাবে শেয়ার মূল্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে মোটা টাকায় এলআইসি’কে শেয়ার বিক্রি করে দাঁও মেরেছে। এখন এলআইসি’র শেয়ার মূল্য পতনের ফলে এলআইসি’র শেয়ার কেনা যাবে সস্তায়। সরকার এলআইসি শেয়ার বিক্রি করে বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে এগচ্ছে। কিনবে কে বেসরকারি মালিকরা। তারা যাতে সস্তায় অর্থাৎ জলের দলে এলআইসি’র মালিকানা হাতাতে পারে তার জন্যই চলছে গভীর ষড়যন্ত্র। নাটের গুরু মোদানিরা।
Editorial on LIC
মোদানি চক্করে বিপন্ন এলআইসি
×
Comments :0