দেশের অর্থনীতির উপর সরকার যতই রুপোলি মোড়ক পরাক না কেন, দেশে এবং আমাদের রাজ্যে কৃষির ভিত্তি আজ বড়ই দুর্বল। কৃষি উৎপাদন কমছে, কৃষি থেকে আয় কমছে এবং পরিবেশের পরিবর্তনে কৃষির উপর আঘাত নেমে আসছে। আমাদের রাজ্যে বেশ কয়েকদিন ধরে আমরা দাবদাহ লক্ষ্য করলাম। দাবদাহ শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, আরও অন্য রাজ্যেও লক্ষ্য করা গেছে। দাবদাহ হতে পারে, এই ধারণা ছিল। দাবদাহ হলে ফসলের ক্ষতি হয়, এই তথ্যও জানা ছিল, তবু এই বিষয়ে আমাদের দেশের রাষ্ট্র বা রাজ্যের সরকার কোনোরকম দায়িত্ব নিল না আমরা দেখলাম।
দাবদাহে যে ফসলের কীরকম ক্ষতি হয়, তার নজির আছে। দেশের সরকারি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে দাবদাহে জর্জরিত দিনগুলি এখন চক্রাকারে আসে এবং ঘুরে ঘুরে এই দাবদাহ আসা বেড়ে চলেছে প্রতি বছরে। ২০২২ সালে ১৯০টি এরকম দাবদাহের চক্র এসেছিল আমাদের দেশে। ২০২১ সালের চেয়ে এই সংখ্যা ছয় গুণ বেশি। ২০২৩ সালে এই দাবদাহ আরও বাড়বে তা আবহাওয়ার সতর্কবার্তায় জানা যায়। দাবদাহে ফসল উৎপাদনে ক্ষতি হয়। আসলে সেচের দাবি বেড়ে যায় এইরকম আবহাওয়ায়, কিন্তু সেচব্যবস্থায় তো সরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। বেসরকারি কেন্দ্র থেকে এবং জল কিনে ফসল ফলানোর জন্য যে পরিমাণ কৃষি আয় থাকা দরকার, আমাদের দেশে এবং বিশেষ করে রাজ্যে তা নেই। এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদন বর্ষার উপর নির্ভরশীল। ২০২২ সালের আগের বছরগুলি ভালো বর্ষা হয়েছিল বলে কৃষি উৎপাদন কমে যায়নি। কিন্তু ২০২২ সাল থেকেই দাবদাহ, অতিবৃষ্টির অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব হর্টিকালচার রিসার্চ জানাচ্ছে যে এই চলতি দাবদাহের ফলে ১০% থেকে ৩০% ফল ও সবজি নষ্ট হবে। ২০২২ সালের দাবদাহে কৃষির যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল, তা ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসেই এই দাবদাহের সতর্কবার্তা ছিল, কিন্তু আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনও উদ্যোগ দেখতে পাইনি ফসল রক্ষার জন্য।
দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনও কৃষি আয়ের উপর নির্ভরশীল। দেশে যত বেকারি বেড়েছে তত কৃষির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে দেশের মানুষ। পরিযায়ী হয়ে যারা রাজ্য ছেড়েছিলেন, তারা অনেক সময়ে কাজ না পেয়ে গ্রামে ফিরে এসেছেন, সেই কৃষিকাজে ফিরে গেছেন। কিন্তু কৃষি থেকে আয় ক্রমাগত কমে এসেছে আমাদের দেশে। বিপন্ন কৃষি ব্যবস্থা, বিপন্ন কৃষক। সম্প্রতি ক্রাইসিল সংস্থার ইন্ডিয়া আউটলুক রিপোর্টে জানা যায় যে কৃষি থেকে আয় ২০২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির জন্য সামান্য বাড়লেও আগামী বছরে তা বাড়বে না। শুধু তাই নয়, দাবদাহ বারবার ঘটতে থাকলে কৃষি উৎপাদন কমে যাবে। ২০২২ সালে রেকর্ড দাবদাহ ফসল নষ্ট করেছিল। বিশেষ করে গম উৎপাদনে এর প্রভাব পড়েছিল। দেশের আবহাওয়া দপ্তর ২০২৩ সালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হবে না বলে জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ২০১৬-১৭ সালের পর চলতি বছরে কৃষি থেকে আয় হবে সর্বনিম্ন। গ্রামীণ মজুরির প্রকৃত হার কমে গেছে মুদ্রাস্ফীতির জন্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে দাবদাহ সহ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেশি সংখ্যায় ঝড়ের পূর্বাভাস ফসলের ক্ষতির দিকে ইঙ্গিত করছে।
আবহাওয়া পরিবর্তন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে আমাদের দেশে একই সাথে দাবদাহ, খরা, ঝড় বৃষ্টি এবং ঠাণ্ডা বেড়ে গিয়ে সবই চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে। এর জন্য সরকার কোনোভাবেই তৈরি নয়। এই পরিস্থিতিতে যে দেশের কৃষিজীবী মানুষ আরও বিপন্নতার মুখে পড়বে এ বিষয়ে সরকারের কোনও চিন্তা আমরা দেখিনি।
সারা ভারত কৃষকসভা মার্চ মাসে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে অনেক রাজ্যে অতিবৃষ্টি রবি শস্যের ক্ষতি করেছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং মধ্য প্রদেশ এর কবলে পড়েছে। সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে সংগঠন সমীক্ষা করে ফসলের ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী ফসল বিমা যেন সরকার ঘোষণা করে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা ঘোষিত হয়। আমাদের রাজ্যে রয়েছে বাংলা শস্য বিমা। সিএজি রিপোর্টে প্রকাশ যে আমাদের রাজ্য সহ আরও ৯টি রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা সেভাবে ব্যবহৃত হয়নি। কৃষকের সমস্যা হলো এই যে এই বিমাগুলি সাধারণভাবে অতিবৃষ্টি বা দাবদাহে ফসলের ক্ষতি হলে তা ব্যক্তিগত স্তরে কৃষকের ক্ষয়ক্ষতি দেখে বিচার করা হয় এই বিমার আওতায় আদৌ তাঁরা পড়বেন কি না। গত বছরের দাবদাহ এবং অতি বৃষ্টির ফলে পশ্চিমবঙ্গ সহ অনেক রাজ্যের ধান উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ফসল বা শস্যবিমা কোনোটাই কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এমনকি বিজেপি শাসিত মধ্য প্রদেশেও প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা বেশির ভাগ কৃষকের কাজে আসেনি কারণ তা শুধু চাষের খরচের কথা ভেবেছে। কিষান ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ঋণ নিলে তা কৃষককে আরও ঋণগ্রস্ত করে তোলে। কৃষক আবহাওয়ার এই চূড়ান্ত অবস্থায় ফসলের ফলন নিয়ে বিপদে পড়লে, সরকারের এই বিমাগুলি তার কোনও কাজে আসছে না। আবহাওয়ার ব্যতিক্রমে ফসলের হঠাৎ অজানা ক্ষতি হলে যেমন হয় দাবদাহ , অতিবৃষ্টিতে, সেই ক্ষতি পরিমাপের কোনও ব্যবস্থাই নেই সরকারের কাছে। সরকার এ বিষয়ে কোনও সমীক্ষা করে না, এমনকি করার কোনও পরিকল্পনাও আছে বলে কোনোদিন প্রকাশ করেনি। ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে চলেছে সব বছরেই বিশেষ করে ২০২২ সাল থেকে আবহাওয়ার কারণে। ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কোনও আন্দাজ ছাড়াই বিজ্ঞাপনের মতো মুখ্যমন্ত্রী গত তিন সপ্তাহ আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করলেন। খরিফ মরশুমে ৩৪৫ কোটি টাকা এবং আগের রবি মরশুমের ৪২৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করলেন। দুটি মিলিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থা হবে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে। কাদের দিলেন এই পরিমাণ টাকা, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পেলেন কি না, তা জানার কোনও উপায় নেই। ক্ষয়ক্ষতি তো ঘটেই চলেছে। সংবাদে প্রকাশিত যে খবর তা থেকেই দেখা যায় যে চলতি দাবদাহের জন্য ক্ষতি হচ্ছে ফল এবং সবজি ফলনে। বসিরহাটে বাঁধাকপি চাষে ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে খবরে। বোরো চাষের ক্ষতি আসন্ন। গম চাষে গত বছরের মতই ক্ষতি হবে। এই ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে কৃষকের বাঁচার কোনও উপায় থাকছে কি? এর কোনও স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটেনি কেন্দ্রের অথবা রাজ্যের সরকার।
কৃষকের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে আমাদের দেশে। গ্রামে খেতমজুরের প্রকৃত মজুরি ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ সালে বেড়েছে মাত্র ০.৯%। কৃষি থেকে আয় কমছে আমরা দেখেছি। মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষি উৎপাদনের অংশ কমে যাচ্ছে প্রতি বছর। ২০২০-২১ সালে তা ছিল ২০.১% , ২০২১-২২ সালে তা হল ১৯.১%, ২০২২-২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৮.৩%। অর্থাৎ কৃষির উপর গ্রামীণ মানুষ বাধ্য হয়ে নির্ভর করছে, কিন্তু তা আদৌ আয়ের পথ খুলে দিচ্ছে না। এই অবস্থায় আবহাওয়াজনিত ক্ষতি বিশেষ করে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে এড়িয়ে চলার কোনও উপায় নেই। গমের উৎপাদন সারা দেশে ব্যাহত হয়েছে, ফলে আটার দাম বাড়ছে। গবাদি পশু এবং পশুপালন এই আবহাওয়ায় কষ্টকর বলে দুধের দাম এবং দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বাড়ছে। আক্রান্ত হয়েছে এবং হতে চলেছে ধানের, ডালের, সয়াবিনের উৎপাদন। এদের দাম বাড়বে, কিন্তু বাজারে দাম বাড়লে তো কৃষক দাম পান না। এই আবহাওয়ার দাম দিতে হবে আর্থিকভাবে বিপন্ন কৃষকদের। এই আবহাওয়ার চূড়ান্ত পরিস্থিতি যা দাবদাহ, অতিরিক্ত উষ্ণতার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে, যা “এল নিনো” বলে পরিচিত, তার সম্ভাবনা এ বছর আছে, এ কথা আগেই আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছিল। ২০২২ সালের অভিজ্ঞতাও জানা ছিল। তা জানা সত্ত্বেও কেন্দ্রের এবং রাজ্যের সরকারের তরফ থেকে সামান্যতম কোনও প্রস্তুতি ছিল না। অন্যদিকে সমস্ত পরিসংখ্যান দেশের কৃষকরা যে বিপন্ন তার প্রমাণ দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষকের ঋণগ্রস্ত হওয়া ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কাছে বা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বাড়ে। অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্য সুরক্ষা থাকে না, অনাহার বাড়ে, পুষ্টির অভাব হয়।
গ্রামীণ মানুষের বেঁচে থাকা, ফসলের উৎপাদন, দাবদাহে ফসল নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণের কথা নির্বাচিত সরকার না ভাবলে কে ভাববে? যে পরিস্থিতির জন্য কৃষক দায়ী নয়, তার মূল্য কেন সে দেবে? দাবদাহ এবং উষ্ণতা বৃদ্ধির সময়ে জনস্বাস্থ্য নিশ্চয়ই চিন্তার বিষয়। কিন্তু যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এর ফলে হয়, তার দায় কে নেবে? নির্বাচিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং রাজ্যের তৃণমুল কংগ্রেস সরকারকে এ বিষয়ে কোনও উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। ফসল বিমা এবং শস্য বিমা এই পরিস্থিতিতে সুবিধা দিতে পারছে না তা দেখাই যাচ্ছে। এই বিমার প্রকল্পগুলি কৃষকদের যত সুবিধা করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা করছে বিমা কোম্পানিগুলিকে। আমাদের রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্বালে ঘোষিত বিমার ক্ষেত্রেও এই কথাই প্রযোজ্য। রাজ্যসভার এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র তোমার জানিয়েছিলেন যে ২০১৬-১৭ সাল থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত এই প্রকল্প বাবদ বিমা সংস্থা ৪০,০০০ কোটি টাকা লাভ করেছে। তাহলে কার লাভের দিকে তাকিয়ে প্রকল্প ঘোষণা করছে সরকার সহজেই বোঝা যায়। দাবদাহ, ঝড়, অতিবৃষ্টিতে ক্ষয়ক্ষতির দায় কি নেবে দেশের সাধারণ মানুষ, নির্বাচিত সরকার না? এই প্রশ্নে আলোড়ন তোলা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নিজেদের অর্থাৎ দেশের মানুষকে, সেই সাথে রাজ্যের মানুষকে বাঁচাতে।
Comments :0