Editorial

মন্দের ভা‍লো

সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial

অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের মানুষদের জন্য সরকারি চাকরি ও উচ্চ শিক্ষায় সংরক্ষণে ১০৩তম সংবিধান সংশোধনীতে সায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে এই রায় দিতে পারেননি। বিভাজিত রায়ে তিন জন পক্ষে এবং দু’জন বিরুদ্ধে অবস্থান নি‍‌য়েছেন। সংরক্ষণ প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মত শুধু বিভিন্ন জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিচারপতিদের মধ্যেও তা সমানভাবে বিরাজমান। এই বিভাজিত রায়ে সাধারণ বর্গের (জেনারেল ক্যাটাগরি) মানুষ ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুবিধা পাবে। তবে তফসিলি, আদিবাসী এবং ওবিসি-রা এই ১০ শতাংশের সুবিধা পাবে না। তারা প্রচলিত নিয়মে শুধু যথাক্রমে ১৫ শতাংশ, ৭.৫ শতাংশ এবং ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন। এই অংশের যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তারা স্বাভাবিকভাবে বঞ্চিত হবেন। এই রায়ের ফলে এখন থেকে সরকারি চাকরি ও উচ্চ শিক্ষায় সবমিলিয়ে ৫৯.৫ শতাংশ সংরক্ষিত থাকবে।  
 

সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা গোড়া থেকেই করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ওবিসি নামে তার সঙ্গে যুক্ত হয় তফসিলি জাতি-উপজাতি ছাড়া অন্যান্য পশ্চাৎপদ অংশকে। তাদের জন্য সংরক্ষিত হয় ২৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে ৪৯.৫ শতাংশ। একটি স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশে সমস্ত নাগরিকদের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যহীনতা অত্যাবশ্যক। সকলের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য, রুজি ইত্যাদি নিশ্চয়তা ছাড়া মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় না। মূলত এই ভাবনা থেকেই নানা ঐতিহাসিক কারণে যুগ যুগ ধরে বঞ্চনায় শিকার হয়ে যা পিছিয়ে পড়েছে তাদেরকে এগিয়ে আশার ব্যবস্থা হিসাবেই সংরক্ষণ স্বাগত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবস্থা পশ্চাৎপদের মধ্যে একটা সুবিধাবাদী অংশ তৈরি করতে সাহায্য করেছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তফসিলি জাতি-উপজাতি এবং ওবিসি-দের মধ্যে একটা সংখ্যালঘু অংশ সেই সুবিধা বেশি পাচ্ছে। ফলে পিছিয়ে পড়াদের বেশিরভাগই যে তিমিরে ছিল সেখানেই থেকে যাচ্ছে। এমন এক বাস্তবতার মধ্যেই দাবি উঠতে শুরু করে জাত, ধর্ম বা ঐ ধরনের অন্যকোনও মাপকাঠির ভিত্তিতে নয় সংরক্ষণের ভিত্তি হবে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা। অর্থাৎ যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তারা যে জাত বা ধ‍‌র্মেরই হোক না কেন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে তার ভিত্তিতেই। বামপন্থীরা গোড়া থেকেই এই অবস্থানের পক্ষে জোরালোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বামপন্থী তথা কমিউনিস্টরা ছাড়া ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই ধর্ম ও জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। ভোট এলেই নানা কৌশল জাতপাতের বিভাজনকে উসকে দিয়ে তাদের খুশি করে ভোট পাবার চেষ্টা করে। বিজেপি এক্ষেত্রে সবার থেকে এগিয়ে তাদের রাজনীতির প্রধান ভিত্তি ধর্ম হলেও ধর্মের আবহে জাতপাতকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা তৈরি করে। বিজেপি প্রধানত বর্ণহিন্দু তথা উঁচুজাতের দল। মনুবাদ তথা ব্রাহ্মণ্যবাদই তাদের রাজনৈতিক আদর্শকে পথ দেখায়। কিন্তু উঁচুজাতের ভোটে যেহেতু জেতা যায় না তাই তারা নানা কৌশলে দলিত আদিবাসীদের মন পেতে দ্বিচারিতার আশ্রয় নেয়। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে তাই সাধারণ বর্গকে খুশি করতে তড়িঘড়ি সংবিধানের ১০৩তম সংশোধনী বিল পাশ করায়। বিজেপি’র প্রভাব বেশি এমন রাজ্য গুজরাট, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে পতিদার, গুজ্জর, জাঠ, মারাঠিরা উচ্চবর্ণের পিছিয়ে পড়াদের জন্য আন্দোলন করছে। মূলত তাদের খুশি করতেই বাড়তি ১০ শতাংশের সংরক্ষণের উদ্যোগ। যদিও এমন উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৯০-র দশকের গোড়ায় নরসিমা রাওয়ের আমলে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দেয় ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না। পরে মনমোহন সিংহের আমলেও উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটাও ব্যর্থ হয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। এতদ সত্ত্বেও ইউ পি এ সরকার এই সংক্রান্ত একটি বিল তৈরি করে ২০১৪ সালে। মোদী ক্ষমতায় এসে পাঁচ বছর পর সেই বিল। সংসদে পাশ করায়। এক্ষেত্রে কার কৃতিত্ব বেশি সেই বিতর্ক অবাস্তব। আসলে কথা জাত-পাত, ধর্মের ঊর্ধ্বে সকল দরিদ্র, অথনৈতিকভাবে দুর্বলতরদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। সকলকে এক সারিতে আনতে যা করার সেটাই করতে হবে। তার জন্য দরকার সমাজ ব্যবস্থাটা বদলানো।  
 

Comments :0

Login to leave a comment