Rail accident

টানা চার রাত কাজের পরেও মালগাড়ি চালককে বাধ্য করা হয় ডিউটি করতে

জাতীয় রাজ্য

 একটানা চার রাত ডিউটি করার পর বিশ্রামে থাকা মালগাড়ির চালককে বাধ্য করা হয়েছিল ফের গাড়ি চালাতে!
ভারতীয় রেলে তিন লক্ষ শূন্যপদ পড়ে আছে। সেফটি ক্যাটাগরিতেও উদ্বেগজনক সংখ্যায় ফাঁকা পড়ে আছে পদ। আর তার মাশুল দিতে হচ্ছে বর্তমান রেল কর্মচারীদের। চার রাত গাড়ি চালিয়ে বিশ্রামে থাকা মালগাড়ির চালককে মধ্যরাতে রানিং রুমের বিছানা থেকে তুলে হাতে ধরানো হয়েছে ডিউটি স্লিপ!
দুর্ঘটনার পর রেল প্রশাসনের তরফ থেকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে মালগাড়ির চালকের ওপর। রাঙাপানি স্টেশনে কাছে শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে এসে ধাক্কা মারে মালগাড়ি। দুর্ঘটনায় মালগাড়ির চালক ও তাঁর সহকারী দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এই মৃত্যুর পরেই মৃত মালগাড়ির চালককেই কাঠগড়ায় তুলেছে রেল প্রশাসন।
কিন্তু টানা চার রাত ডিউটি করার পর গত রবিবার রাতে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের রানিং রুমে বিশ্রামে ছিলেন মালগাড়ির চালক। রাত প্রায় আড়াইটা থেকে তাঁর ওপর রেল প্রশাসন ফের ডিউটিতে যাবার জন্য চাপ তৈরি করতে থাকে। বিশ্রামে থাকা চালক রাজি হননি। কিন্তু সকাল ৬টা ৪০ মিনিট নাগাদ তাঁকে ডিউটি করার জন্য একপ্রকার বাধ্য করানো হয়েছিল। ভয়ানক দুর্ঘটনার পরে রেলকর্মীরাই এখন রেল প্রশাসনের এই অমানবিক আচরণের তীব্র নিন্দা করছেন। 
গত ছয় মাস আগে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের এই রেলপথে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় থেকে ছয় ঘণ্টা আগে থেকে ওই পথে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ ছিল। ফলে পুরানো পদ্ধতি মেনে চালু রাখা ছিল সিগন্যাল। আর তারজন্য রেলের তরফে চালকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, ‘টিএ ৯১২’ ফরম। কিন্তু ম্যানুয়াল সিগন্যাল ব্যবস্থায় ‘টিএ ৯১২’ ফরমে চালকদের কোনও গতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা নয়। গতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চালকদের কাছে ‘টি/জি ৯১২’ ফরম দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রেলের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মালগাড়ির চালকের কাছে গতি নিয়ন্ত্রণের ফরম দেওয়া হয়নি। 
রেল কর্মচারীদের স্পষ্ট অভিযোগ, রেলের রানিং স্টাফ মানে চালক ও সহকারী চালকরা কতক্ষণ ডিউটি করবেন তার নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করা আছে। কর্নাটক ক্যাট (সেন্ট্রাল এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল) ও ব্যাঙ্গালুরু হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, একজন চালক ১০ ঘণ্টা ডিউটি করবে। মালগাড়ি থেকে এক্সপ্রেস ট্রেন চালানোর দু’টি ডিউটির মাঝে কমপক্ষে ১৬ ঘণ্টা বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে চালকদের। একইসঙ্গে সাপ্তাহিক ২৬ ঘণ্টা বিশ্রামের ব্যবস্থা করার ব্যবস্থা করবে রেল মন্ত্রক। আদালতের এই নির্দেশের বাইরেও নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত রেলকর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট ডিউটি ম্যানুয়াল আছে। আইন ও বিধি কোনও কিছুরই তোয়াক্কা না করে রেল কর্মচারীদের ওপর চাপানো হচ্ছে বিস্তর কাজের বোঝা। ইস্ট্রার্ন রেলওয়েমেন্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অমিত বর্মণ জানান, ‘‘ দুর্ঘটনায় মালগাড়ির চালক প্রাণ হারিয়েছেন। আর রেল প্রশাসন এখন সেই চালকের ওপর দায় চাপিয়ে বাঁচতে চাইছে। রেলের নিয়ম নীতিকে অগ্রাহ্য করে রেল কর্মচারীদের ওপর কাজের বোঝা চাপানোর দায় এইভাবে এড়িয়ে যেতে চাইছে রেল মন্ত্রক। এ জিনিস মানা হবে না।’’
মোদী সরকারের আমলে রেল মন্ত্রক কার্যত পরিষেবার পরিবর্তে আয় করার ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে উঠেছে। ২০২০ সালের ২০ মার্চ কোভিড পর্বে ভারতীয় রেল যাত্রীদের ওপর থেকে সব ধরণের ছাড় প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কোভিড পার হয়ে গেলেও রেলের প্রবীণ নাগরিকদের ওপর যাত্রীভাড়ায় সেই ছাড় ফিরিয়ে আনা হয়নি। তথ্যের অধিকার আইনের মাধ্যমেই জানা গেছে, কোভিড পর্বে প্রত্যাহার করা প্রবীণ নাগরিকদের রেলযাত্রায় ছাড় তুলে দিয়ে ভারতীয় রেল প্রায় ৫ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করেছে। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় রেলে প্রবীণ পুরুষ যাত্রীদের রেলের টিকিটের ওপর ৪০ শতাংশ ও প্রবীণ মহিলাদের ৫০ শতাংশ ছাড় দিত রেল। কিন্তু এখন স্রেফ ব্যবসা করতে গিয়ে ভারতীয় রেলের যাত্রী পরিষেবাকে শিকেয় তুলে মুনাফাতে ব্যস্ত রেল মন্ত্রক।
আর মুনাফার হাত ধরেই রেলে এখন ব্যাপক হারে বেসরকারিকরণ চলছে। গত বছর জুন মাসে ওডিশার বাহানাগা রেল স্টেশনে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়া করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সঙ্গে বছর ঘুরতে উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের অধীনে রাঙাপানি স্টেশনে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় মিল খুঁজে পাচ্ছেন রেল কর্মচারীরাই।
রেল প্রশাসন সূত্রেই জানা গেছে, এদিন সকালে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই রেলপথে ছয় মাস আগে সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে। কিন্তু গত ছয় ঘণ্টা ধরে ওই রেলপথে প্রযুক্তিগত কোনো ত্রুটির জন্যই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু ছিল না। ফলে পুরানো পদ্ধতিতেই রেলপথ দিয়ে চালানো হচ্ছিল ট্রেন। রেল কর্মচারীদের বক্তব্য, ‘‘ আসলে ভারতীয় রেলের নিজস্ব সিগন্যাল ব্যবস্থা আছে। তার আধুনিক বিভাগও আছে। কিন্তু বর্তমানে গোটা ব্যবস্থাকেই বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে আউটসোর্স করে দেওয়া হয়েছে। এখন অটোমেটেড সিগন্যাল ব্যবস্থার বরাত দেওয়া হয়েছে বেসরকারি হাতে। আবার সেই ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটি ধরা পড়লে তার রক্ষণাবেক্ষণের বরাত দেওয়া আছে অন্য এক সংস্থার হাতে।’’  রেলযাত্রীদের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত বিভাগকে আউটসোর্স করে দেওয়ার চূড়ান্ত পরিণতিতেই ঘটে যাচ্ছে একের পর রেল দুর্ঘটনা। 
 

 

Comments :0

Login to leave a comment