Panchayat vote 2023

নিখোঁজ প্রার্থী জাহানারা, আক্রান্ত গ্রামে প্রতিনিধিদল

জেলা

 ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। এখনও খোঁজ নেই জাহানারা বিবির। খোঁজ নেই তাঁর স্বামী আইএসএফ নেতা কারিমুল মোল্লার।
জাহানারা বিবি ভাঙড় থেকে সিপিআই(এম) সমর্থিত আইএসএফ প্রার্থী। গণনাকেন্দ্রে তাঁকে কেন্দ্র করেই তৃণমূলের গন্ডগোল, তাঁকে হারাতে পুলিশ প্রশাসন ও বিডিও’র জোরজবরদস্তি এবং তাঁর জেরে কাঁঠালিয়া হাইস্কুলে বিক্ষোভের ঘটনা, গুলিতে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক সহ তিনজনের মৃত্যু। মঙ্গলবার গভীর রাতে রাস্তার আলো বন্ধ করে নির্বিচারে যেভাবে গুলি চলেছে তা কার্যত গণহত্যারই শামিল। 
সেদিনে রাতের ঘটনা যে শাসক তৃণমূলেরই ‘অবদান’ তা স্পষ্ট হয়েছে বৃহস্পতিবার দলেরই কর্মীসভায় খোদ আরাবুল ইসলামের ভাষণে। সেদিন শুধু পুলিশ নয় শাসক তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনীও হামলা চালিয়েছিল তা আরাবুল ইসলামের কথাতেই পরিষ্কার। 
কী বলেছেন আরাবুল ইসলাম? এদিন ভাঙড়ে দলীয় সভায় সেদিন রাতের ঘটনা উল্লেখ করেই আরাবুল ইসলাম বলেন, ‘আইএসএফের কর্মীরা সেদিন কাউন্টিং সেন্টারেই বলছিল আরাবুলের মাথা চাই। আমাদের নেতা, অভিভাবক সওকত মোল্লা সেদিন সারা রাত ধরে যেভাবে লড়াই চালালো, ভোর রাত পর্যন্ত যেভাবে লড়াই চালালো আমাদের হয়ে তাতে আমরা কৃতজ্ঞ, না হলে ভাঙড় উদ্ধার করতে পারতাম না!’
‘লড়াই’ মানে? গণনাকেন্দ্র ভাঙড়ের কাঁঠালিয়া হাইস্কুলে। সওকত মোল্লা ক্যানিং পূর্ব কেন্দ্রের বিধায়ক। তাহলে ১১ জুলাই ভাঙড়-২নম্বর ব্লকের জেলা পরিষদ ও সমিতির ভোট গণনাকেন্দ্রে সারা রাত কী করছিলেন ক্যানিং পূর্বের আরেক বাহুবলী বিধায়ক? গণনাকেন্দ্রে কীসের লড়াই করে সওকত মোল্লা ভাঙড় উদ্ধার করল ? 
আর সেই লড়াইয়ের ফলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হলো গ্রামবাসী সহ তিনজন আইএসএফ সর্মথক, গুলিবিদ্ধ আরও একাধিকজন। তাহলে গুলি চালালো কে? গণনাকেন্দ্রের ভিতরে সারা রাত তাহলে সওকত মোল্লা, আরাবুল ইসলামরা ছিলেন কেন? তাহলে কি পুলিশের পোশাকে গুলি চালালো সওকত মোল্লার দুষ্কৃতী বাহিনী? আরাবুল ইসলামের বক্তব্যের সেই ভিডিও সোসাল মিডিয়াতে এমনকি স্থানীয় ইউটিউব চ্যানেলগুলিতেই প্রচারিত হয়েছে। 
গণনাকেন্দ্রের ভিতরে থেকেই পাশের কেন্দ্রের বিধায়ক কীভাবে ‘ভাঙড় উদ্ধার’ করে দিল তা জানেন গোটা ভাঙড়ের মানুষই। ক্যানিং পূর্ব কেন্দ্রের গোটা ব্লকে সশস্ত্র দুষ্কৃতী দিয়ে ভোট-হীন রাখা হয়। কোন বিরোধীদলের কেউ সেখানে প্রার্থী হতে পারেনি। আর ক্যানিংয়ের সেই দুষ্কৃতীবাহিনীকেই ভোটের দিন ব্যবহার করা হয় ভাঙড় এমনকি নন্দীগ্রামেও। গণনার দিনও যে সওকতের বাহিনী ভাঙড়ে ছিলে এবং ‘সারা রাত ধরে লড়াই করেছে’ তা এবার স্বীকার করলেন খোদ আরাবুল ইসলাম।
ঐ গণনাকেন্দ্রেই রাত সাড়ে আটটার সময় দেখা যায় সিপিআই(এম) সমর্থিত আইএসএফ প্রার্থী জাহানারা চার হাজারের বেশি ভোটে জিতেছেন। যদিও তারপরে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে আটকে রেখে তাঁকে সাদা কাগজে সই করতে বাধ্যও করা হয়। তিন ঘণ্টা ধরে সার্টিফিকেট না দিয়ে পরে রাতে জানানো হয় তৃণমূল প্রার্থী ৩৬০ভোট জিতে গেছেন। এরপরেই ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন গণনাকেন্দ্রে বাইরে। সেই রাত থেকেই আলাখুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা জাহানারা বিবি ও তাঁর স্বামী কারিমুল মোল্লা নিখোঁজ। এদিন কারিমুল মোল্লার মা সহরবানু কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছিলেন, ‘বৌমা জিতে গেছে শুনেছিলাম। তারপরেও হামলা হয়েছে। আমাদের বাড়িতে পুলিশ এসে লন্ডভন্ড করে গেছে। দুদিন হয়েছে ছেলে বৌমা বাড়িতে ফেরেনি। আমরা বুড়ো মানুষ ঘরে পড়ে আছি। বৌমা ভোটে লড়াই করেছে, এটা কী অপরাধ?’ 
এদিন এই ঘটনাবহুল ভাঙড়েই নিহত গ্রামবাসী ও আইএসএফ কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান, সর্বতোভাবে পাশে থাকার আশ্বাস দেন রাজ্যসভায় সিপিআই(এম) সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। বৃহস্পতিবার বিকালে পুলিশি অত্যাচারে সন্ত্রস্ত ভাঙড়ে আসে সেভ ডেমোক্র্যাসি ও আইনজীবী সংগঠন এআইএলইউ’র কলকাতা হাইকোর্ট কমিটির এক প্রতিনিধিদল। তাঁরা এদিন ভাঙড়ে পুলিশের গুলিতে মৃত কাটাভাঙার বাসিন্দা মানসিক ভারসাম্যহীন রাজু মোল্লা, কাটাডাঙার বাসিন্দা হাসান মোল্লা ও কারবালার বাসিন্দা রেজাউল গাজীর বাড়িতে যান। 
হাসান মোল্লার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। একেবারে গরিব পরিবার। দশ বছরের এক পুত্র সন্তান ও ছয় বছরের এক সন্তানও রয়েছে। এদিন বিকাশ ভট্টাচার্যের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে তানজিরা বিবি বলেন, আমরা কীভাবে বাঁচবো জানি না। কীভাবে চলবে সংসার? বাচ্চাকে বড় করবো কীভাবে? পুলিশের গুলি একেবারে ডানদিকে মাথা ও কপালে লেগেছিল হাসান মোল্লার। চামড়ার ব্যাগ বানানোর কাজ করতেন। ভেঙে পড়া ঘর, নিদারুণ দারিদ্র। একই অবস্থা রাজু মোল্লা ও রাজীবুল গাজির বাড়িতেও।
প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য, এআইএলইউ’ কলকাতা হাইকোর্ট কমিটির সম্পাদক সামিম আহমেদ, আইনজীবী রাজিত লাল মৈত্র, তাপস মাইতি, সিদ্ধার্থশঙ্কর মণ্ডল এবং সেভ ডেমোক্র্যাসির তরফে দীপালি ভট্টাচার্য, অধ্যাপক সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্রশিল্পী পার্থ চ্যাটার্জি। তাঁরা নিহতের পরিবারের পাশে থাকবেন, ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে সঙ্গে থাকবেন বলেই জানান।
বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, রাষ্ট্রশক্তির ভয়াবহ চেহারা। মাথায় গুলি করে মারা হয়েছে। আমরা আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাস্তার লড়াইয়েও থাকবে। সরকারের কাছ মৃতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি জানাবো। না হলে আইনি ব্যবস্থার পথেই হাঁটবো। এই মানুষগুলির পাশে আছি সবাই। মমতা ব্যানার্জির সরকারের বর্বরতার চেহারার নজির ভাঙড় জুড়ে। আইনজীবী সামিম আহমেদ জানান, আমরা হাইকোর্ট কমিটির তরফে ভাঙড়ে পুলিশি অত্যাচার, যাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে তাঁদের পাশে আইনি সহায়তা নিয়েই দাঁড়াবো।
এদিন এই প্রতিনিধিদল এরপরে ভোমরু গ্রামেও যায়, সেখানে প্রায় শ’দুয়েক মহিলা তাঁদের ক্ষোভের কথা জানান। মাকসুদা খাতুন, হামিদা বিবি, পারলি বিবির মতো গৃহবধূরা জানান, আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছে তৃণমূল আর পুলিশ। গ্রাম পুরুষশূন্য। পুলিশ দিনভর তল্লাশির নামে তাণ্ডব করছে, যাকে পারছে ধরছে, সারা রাত আমাদের ঘুম নেই।
এদিকে এরই মধ্যে এদিন বৃহস্পতিবার চালতাবেড়িয়ার একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তাতে চারজন গুরুতরভাবে আহত হয়। আহতদের নাম ইমরান মোল্লা, ইনজামুল মোল্লা, সাকির হোসেন মোল্লা, রাফিক মোল্লা। পুলিশের দাবি, এরা আইএসএফ সমর্থক। বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণ। যদিও আইএসএফ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। চারজন গুরুতর আহত সহ মোট সাতজন আহতকে চিকিৎসার জন্য কলকাতার দিকে নিয়ে যেতে গেলে কেএলসি থানার পুলিশ বাসন্তী হাইওয়েতে কাটাডাঙার সামনে তাদের গাড়ি আটকায়। ঐ অবস্থাতেই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। গুরুতর জখমদের পুলিশ তরফে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এই বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে চালতাবেড়িয়ায় পুলিশ ঘরে ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালাচ্ছে। তৃণমূল বিরোধীদের বাড়িতে ঢুকে চলছে হেনস্তা। 
চালতাবেড়িয়াতেই ভোটের দিন গুলি চলে, আরাবুল বাহিনীর হামলায় তিনজন ভোটার গুলিবিদ্ধ হন। এখানে মোট আসন ৩০টি। এর মধ্যে ভোট হয়েছে ২০টি আসনে। ৪টিতে অবাধ ছাপ্পা। ১৩টি আসনে জিতেছেন আইএসএফ প্রার্থীরা। এতেই পুলিশ আর তৃণমূল আরও তৎপর হয়ে উঠেছে এখানে।
 

Comments :0

Login to leave a comment