MUKTADHARA / ANYAKATHA — Pallav Mukhopadhyay / PARBAN — 14 JANUARY 2024

মুক্তধারা / অন্যকথা / নবান্ন-পিঠে-পুলি — পল্লব মুখোপাধ্যায় — ১৪ জানুয়ারি ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA  ANYAKATHA   Pallav Mukhopadhyay  PARBAN   14 JANUARY 2024

মুক্তধারা   

অন্যকথা

নবান্ন-পিঠে-পুলি
পল্লব মুখোপাধ্যায়

নবান্ন শস্যভিত্তিক একটি লোকউৎসব। কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় প্রধান শস্য
সংগ্রহকে কেন্দ্র করে এ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি,
সন্তান-সন্ততি ও পশুসম্পদ কামনা এ উৎসব প্রচলনের প্রধান কারণ।
উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওয়াজিরাবাদে নবান্ন উৎসব পালিত হয় বৈশাখ মাসে। সেখানে
রবিশস্য গম ঘরে তোলার আনন্দে এ বৈশাখী নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। দক্ষিণ
ভারতেও প্রচলিত আছে এমনই ধরনের নবান্ন উৎসব। বাংলাদেশের কয়েকটি
উপজাতিও তাদের প্রধান ফসল ঘরে তোলার পর নবান্ন উৎসব পালন করে। সাঁওতালরা
পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদ্যাপন করে সোহরায় উৎসব।
ঢেঁকিতে ধান ভাঙা পিঠে তৈরি পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব-এর সঙ্গে
সমার্থক । হেমন্তে আমন ধান কাটার পর অগ্রহায়ণ কিংবা পৌষ মাসে গৃহস্থরা এ
উৎসব পালনে মেতে ওঠেন । উৎসবের প্রধান অঙ্গ নতুন চালে গৃহকর্তা ও তার
পরিবার-এর নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ । এ উপলক্ষ্যে বাড়ির প্রাঙ্গণে আলপনা
আঁকা হত। পিঠে-পায়েসের আদান-প্রদান এবং আত্মীয়-স্বজনের আগমনে গ্রাম বাংলার
পল্লীর প্রতিটি গৃহের পরিবেশ হয়ে ওঠে মধুময়। সর্বত্র উৎসবের আবহ, শাঁখের শব্দ
ইত্যাদিতে গ্রামাঞ্চল হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। পাড়ায়-পাড়ায়, বাড়িতে-বাড়িতে বসে কীর্তন,
পালাগান ও জারিগানের আসর। কৃষকরা নতুন ধান বিক্রি করে নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ
কেনেন।
বাঙালির সংক্রান্তি উদযাপন মানেই পিঠে-পুলি। বাংলায় নানা রকমের পিঠে তৈরি হয়।
বর বা কনে বরণ অনুষ্ঠান, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের আগমন, পারিবারিক
অনুষ্ঠান এবং অতিথি আপ্যায়নে পিঠে-পুলি পরিবেশন করা হয়। অনেক সময় শিশুরা
কিংবা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা পিঠে-পুলি বানানোর আবদার করে, সেই আবদার
রক্ষায় ঠাকুরমা, দিদিমা, জ্যাঠাইমা, মা, কাকিমা, পিসিমা, মাসিমারা পিঠে-পুলি তৈরি করে
থাকেন। পিঠে আকার-আকৃতিতে বিচিত্র। কোনও কোনও পিঠে আছে যা তৈরির বিষয়টি
রীতিমতো অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। অনেক সময় গ্রামে প্রতিবেশীরা একসাথে মিলে পিঠে
তৈরির আয়োজন করেন।
বেশিরভাগ পিঠেই মিষ্টিজাতীয়, তবে ঝাল-টক পিঠেও কম নয়। সারাবছরই পিঠে তৈরি হয়,
তবে কিছু কিছু পিঠে মৌসুমি। শীতকালের পিঠে সবচেয়ে সুস্বাদু। এ সময়ে খেজুরের রস,
খেজুর ও আখের গুড় পাওয়া যায়, যা দিয়ে উপাদেয় পিঠে তৈরি হয়। আসলে পিঠের মরশুম
শুরু হয় হেমন্তে, যখন কৃষকরা ঘরে ধান তোলেন।

তবে প্রত্যেক এলাকায় আলাদা ধরনের পিঠে রয়েছে। আবার একই ধরনের পিঠে এলাকা
ভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। এমন কিছু পিঠে আছে যা সারাদেশেই প্রসিদ্ধ এবং
জনপ্রিয়। এগুলি হচ্ছে চিতই, পাটিসাপটা, পাকান, ভাপা, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠে, ছিট
পিঠে, গোকুল পিঠে, চুটকি পিঠে, মুঠি পিঠে, জামদানি পিঠে, হাঁড়ি পিঠে, চাপড়ি পিঠে, নকশি
পিঠে, পাতা পিঠে, তেজপাতা পিঠে, ঝুরি পিঠে, ফুলঝুরি পিঠে প্রভৃতি ।
পিঠে তৈরির সাধারণ উপাদান হচ্ছে চালের গুঁড়ো, ময়দা, গুড় বা চিনি, নারকেল ও তেল।
কোনও কোনও সময় কাঁঠাল, তাল, নারকেল, কলা ইত্যাদি ফল দিয়েও পিঠে বানানো হয়।
পাতায় মুড়িয়ে এক ধরনের বিশেষ পিঠে তৈরি হয়, যাকে পাতা পিঠে বলা হয়। কিছু কিছু
পিঠের আকার অনুযায়ী নামকরণ করা হয়, যেমন বড় ধরনের পিঠেকে হাঁড়ি পিঠে এবং
ছোট আকৃতির এক ধরনের পিঠেকে খেজুর পিঠে বলা হয়।
বরকে বরণ করা উপলক্ষে কারুকার্যখচিত, বর্ণাঢ্য ও আকর্ষণীয় নানা রকমের পিঠে
তৈরি হয়। এ ধরনের পিঠের নাম বিবিয়ানা অর্থাৎ বিবি বা কনের পারদর্শিতা। এ ধরনের
পিঠেকে জামাই ভোলানো পিঠেও বলা হয়।
পিঠে-পুলি বাংলার জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। বর্তমানে প্রধানত শহর
এলাকায় কেক, পেস্ট্রি ও বাণিজ্যিকভাবে তৈরি অন্যান্য খাবার ঐতিহ্যবাহী ঘরে তৈরি
পিঠে-পুলির স্থান দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখনও পিঠে-পুলির কদর আছে, এমনকি
শহরেও তা সমাদৃত। বর্তমানে শহরের অভিজাত বিপণিতে পিঠে-পুলি পাওয়া যায়। রাস্তার
ধারে ছোট দোকানিরা পিঠে-পুলি বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে। এঁদের বেশির ভাগ
খদ্দেরই গ্রাম থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষ, এঁরাই শহরে গ্রামের পিঠে-পুলির স্বাদ নিয়ে
এসেছেন।

Comments :0

Login to leave a comment