MUKTADHARA — STORY / ABIR DA — 15 JANUARY 2024

মুক্তধারা / গল্প — হেরে গেছি? — আবীর দা / ১৫ জানুয়ারি ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA    STORY  ABIR DA  15 JANUARY 2024

মুক্তধারা  

গল্প

হেরে গেছি?

আবীর দা

জিততে হবে। আমাদের কি প্রতিদিন জিততে হবে? তুমি বলবে, হারতেও হবে। আমি যদি বলি, কেনই বা হারতে হবে? মাঝে মাঝে জিতব বলে? কী ঝঞ্ঝাট!
ক্লাস নাইনের মিমি সকাল সকাল পড়ার টেবিলে বসে মরাল সায়েন্সের বই খুলে এসব ভাবছে। এখন পুজোর সময়। তার ক-দিন আগে থেকেই রাস্তার ওপারে বিধায়ক সাহেবের পুজোয় তারস্বরে মাইক বাজতে শুরু করে দিয়েছে। দিনক্ষণ চুলোয় দিয়ে রোজ মহালয়ার খানিকটা দিয়ে শুরু হয়, তারপর পুজোর মন্ত্র, স্থানীয় সস্তাদরের শিল্পীর গান, প্রত‍্যেকদিন ঘোষকের গলায় তারস্বরে বিধায়কের প্রশংসা, তারপর দুপুরে রেকর্ডে গান বাজানো, সন্ধ‍্যায় দর্শনার্থীদের ভিড় সামলাতে মাইকে চিৎকার, রাতে দামি শিল্পীর গান রোজই এসব শুনতে শুনতে মিমি ভাবে, সারা শহর জুড়ে এও তো এক প্রতিযোগিতা। জেতার জন‍্য, পুরস্কারের জন‍্য কত টাকা খরচ, পাগলের মতো রেষারেষি। আমাদের দেশ কত বড়লোক! আমাদের কত টাকা! সবাই কত খুশি! সারা বছর ধরে চলতে থাকা হরেকরকম পুজোয় প্রবল প্রতিযোগিতা। কার পুজো কত বড়ো, কে কত কোটি টাকা খরচ করল, কার পুজো ক-টা পুরস্কার জিতে নিল এমন কত জিজ্ঞাসা, কে জিতল, কে হেরে গেল। উল্লাসের ছবি কারা কত তুলতে পারল, ক-টা ছবি ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে আপলোড করল সে সবেরও প্রতিযোগিতা চলছে। তবে ওর সোশ‍্যাল সায়েন্সের স‍্যার যে বলেন, এ দেশটার অর্ধেকের বেশি মানুষ হতদরিদ্র এবং কষ্ট করে দিন চালায়। নিশ্চয়ই স‍্যারের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

আমরা তাহলে কখন হেরে যাই? এসব ভাবতে ভাবতেই মা ও ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলে, আর বইমুখে বসে থাকতে হবে না, যা পড়া হচ্ছে! তার চেয়ে চল্ ব্লকের পুজোয়। আজ ষষ্ঠী, মায়ের মুখটাও দেখবি, আর ব্লকে আজ বস্ত্র বিতরণ। অলরেডি বিরাট লাইন পড়ে গেছে। 
কী বুঝে, না -বুঝে মিমি বলে ওঠে, আমরাও কি লাইনে দাঁড়াব? বস্ত্র কি?
একটা চড় লাগাব, মা হাত বাগিয়ে ছুটে এসে বলে, আমরা কেন দাঁড়াতে যাব? যারা লাইনে দাঁড়াবার তারাই দাঁড়াবে। তারপর গলা নামিয়ে বুঝিয়ে বলে, যাদের পুজোয় নতুন জামা কাপড় হয়নি, যাদের কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের নতুন বস্ত্র বিতরণ করা হবে। আমরা তাদের হাতে তুলে দেব। যাই হোক, তৈরি হয়ে নাও। আজ তুমি আমাদের দেওয়া জামা পরবে। সিটি মল থেকে গাউন মতো যেটা কেনা হল, সেটা।

মিমি কী ভাবতে ভাবতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, 'যারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তারা কি হাত পেতে চাইবে? আর তখন তোমরা কাপড় তুলে দেবে?'
'আরে না না, যাদের কাছে কুপন আছে, তারাই শুধু লাইন দেবে', মা রান্নাঘর থেকে বলল।
'আর যারা পায়নি?'
'মিমি বোকা বোকা কথা বলিস না, তারা লাইন দেবে না। আর ভেবে দেখ, সবাইকে তো দেওয়া সম্ভব না'।
আর কথা না -বাড়িয়ে মিমি নতুন জামা হাতে নিয়ে চেঞ্জ করতে ছোটো ঘরে ঢুকল।

হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার পুজো প‍্যান্ডেলের যত কাছে যায় মাইকের আওয়াজ তত বাড়তে থাকে। বুঝতে পারে লাইন পড়ে গেছে, এ লাইন ওর নয়, কিন্তু আরও কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ও, তাদের মধ‍্যে আবার যাদের কুপন আছে তারাই দাঁড়াবে।
প‍্যান্ডেলের ঠিক আগেই রাস্তার মোড়ের  ফুটপাথ ধরে যেতে যেতে দুর থেকেও ঠাকুর দেখা যাচ্ছে কিনা উঁকি মারতে মারতেই একটা গলার আওয়াজে ফিরে তাকাল মিমি। হাতে টান পড়তে মা বিরক্ত হয়ে বলল, 'মিমি দাঁড়িয়ে যাস না, প‍্যান্ডেলে চল্'। 
'আচ্ছা, তুই আয়, আমি প‍্যান্ডেলে ঢুকি, বস্ত্র বিতরণ শুরু হয়ে গেছে। এদিক -ওদিক যাস না যেন, এখানেই থাকবি'।
মা এগোতেই, মিমি এবার পিছন ফিরে তাকাল। দেখল পাড়ার এক কাকুকে মায়ের থেকেও বড়ো এক বয়স্ক মহিলা বলছে, 
'বাবা, আমায় একটা কাপড় দেবে, আমি কুপন পাইনি। বলো, এই বাজারে কিনব সে পয়সা কোথায়?'
কালো কালো দাগ লাগা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলল, 'কী বলব বাবা, আমার স্বামী আর -একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়েছে। আমার দুটো মেয়ে, একটারে দিয়েছে বিক্রি করে। স্বামী আমাকে দেখে না, জানো!
দাও না একখানা কাপড় নিয়ে যাই ঘরে। তুমি দেখো দাদা, একখানা কাপড়, আমি এইখানে বসি ততক্ষণ। এখন আর বেশি সময় দাঁড়াইতে পারি না'। 
এই বলে ফুটপাথের চাতালে বসে পড়ল। রোদ তখন ঠিক মাথায়।
মিমি দাঁড়িয়ে গেল। পা যেন আর চলছে না। ওদিকে মা এগিয়ে গেছে। প্রবল বেগে নাম ঘোষণা হচ্ছে, সঙ্গে প্রবল বকাবকি, 'আর ঝামেলা করলে বস্ত্র দেওয়াই বন্ধ করে দেব। এই লাইনে দাঁড়া...যে শাড়িটা পেয়েছ ওটাই নিয়ে যাও। কোনো বদলানো হবে না। যে বদলাতে আসবে তাকে আর শাড়িই দেব না'। শুধু কিছুটা দুরে মিমি কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইল। বলতে পারল না, শুধু ভাবল, শহর জোড়া লেখা, গাদা গাদা পুরস্কার, দামি জামা জুতোর পরও আমি আজ তাদেরই একজন। আমি কি হেরে গেছি?

Comments :0

Login to leave a comment