অনির্বাণ দে: বহরমপুর
উৎসবে ফিরেও স্বস্তি নেই। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে কাজের অভাব, ভিনরাজ্যে অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতায় শঙ্কিত মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকরা।
রবিবার গিয়েছে ঈদ। উৎসবে শামিল হতে শুক্রবার বাড়ি ফিরেছেন জলঙ্গির সাদিখাঁদিয়াড় গ্রামের ইকবাল হক। বছর তিরিশের ইকবাল জানাচ্ছেন, বাড়িতে রয়েছেন বয়স্ক বাবা, মা। রয়েছেন স্ত্রী, সন্তান। উৎসবে সবার সঙ্গে আনন্দ করতেই ফেরা। কিন্তু বাড়ি এসেই ফেরার চিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে। কাজে না ফিরলে দিন চলবে কীভাবে?
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে কেটেছেন টিকিট। প্রথমে বহরমপুর থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ। তারপর হাওড়া থেকে অন্ধ্র প্রদেশ। হাওড়া থেকে ট্রেনের টিকিট এখনও কনফার্ম হয়নি। ওয়েটিং লিস্টে আছে।
পেশায় নির্মাণ শ্রমিক ইকবালের কথায়, রাজ্যে কাজ নেই বলে উৎসবে ফিরেও মাস দু’য়েক থাকার জোগাড় নেই। তাই এই সময়ে সবারই কাজে ফেরার তাড়া। তাই ট্রেনেও হবে ভিড়।
জেলায় কাজের অভাব, আরও কম মজুরি। দু’য়ের কারণেই জুলাই মাস জুড়ে ফের ঘর ছাড়তে বাধ্য হবেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। কিন্তু ভিন রাজ্যে বারবার বিপদে পড়ছেন মুর্শিদাবাদ থেকে যাওয়া শ্রমিকরা। কাজে নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। প্রতি মাসেই ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের মৃত্যুর খবর আসে জেলায়। শ্রমিকদের থাকা, খাওয়া, স্বাস্থ্যেরও পর্যাপ্ত পরিকাঠামো থাকে না কর্মস্থলে। অনেক ক্ষেত্রে দালালদের পাল্লায় পড়তে হয় শ্রমিকদের। কোনও প্রশ্নই যদিও রাজ্য সরকারের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রশ্ন নয়।
পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক ইউনিয়নের মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক কামাল হোসেনের কথায়, ‘‘এই যে শ্রমিকরা ফিরবেন, বিভিন্ন রাজ্যে কাজে যাবেন, কোনও ঠিকাদার তাঁদের নিয়ে যাবে? কোথায় কাজে যাবেন? কোনও তথ্য রাখতেই আগ্রহী নয় রাজ্য সরকার। তাই ঝুঁকি নিয়েই কাজে পাড়ি দিতে হচ্ছে। শ্রমিকরা বিপদে পড়লে পুলিশ, প্রশাসনের কোনও সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না।’’
কামাল হোসেনের দাবি, নামে পরিযায়ী শ্রমিকদের বোর্ড হয়েছে। শ্রমিকরা অনেকে পোর্টালে নাম নথিভুক্তও করেছেন। কিন্তু তাতে শ্রমিকরা কী সুবিধা পাবেন, সেটাও স্পষ্ট নয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ভাবতে নারাজ সরকার। শুধু বিজ্ঞাপনেই নজর রাজ্য সরকারের।
একই অভিমত বহরমপুর শহর লাগোয়া ববরপুরের মিলন শেখ, রফিকুল শেখের। দু’জনেই পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে পোর্টালে নাম তুলেছেন। কিন্তু তাতে কী সুবিধা পাওয়া যায়? উত্তর নেই শ্রমিকদের কাছে।
বরং তাঁদের প্রশ্ন, কবে রাজ্যেই কাজ মিলবে? সেটা নিয়ে ভাবুক সরকার। এরাজ্যে গ্রামে একশো দিনের কাজ নিয়ে বাজার গরম করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু কাজ পাননি রাজ্যের মানুষ। রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্পের কথাও।
তবে সেই প্রকল্পের ঘোষণা গ্রামের শ্রমিকদের ভরসা দিতে পারছে না। পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিমার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তারও বাস্তবায়নের কোনও সম্ভাবনা দেখছেন না পরিযায়ী শ্রমিকরা।
জলঙ্গির ইদ্রিস শেখের দাবি, ‘‘গ্রামে কাজ চাইছি, এটা বলছি না। অন্তত রাজ্যে কাজের ব্যবস্থা হোক। তাহলে এত কষ্ট করে অন্য রাজ্যে প্রতিদিন কাজ খুঁজতে যেতে হবে না।’’ ইদ্রিস শেখ জানাচ্ছেন, অন্য বছর ঈদে বাড়ি ফিরলে চাষের কাজে কিছুটা সময় দেওয়া যায়। অনেকে খেতমজুরের কাজও করেন। কিন্তু এই বছর এখনও বৃষ্টির দেখা না মেলায় চাষের কাজও নেই। তাই ভিনরাজ্যে ফেরা ছাড়া কোনও গতি নেই গ্রামের যুবক থেকে মধ্যবয়স্কদের কাছে।
কেরালায় চাষের জমিতে কাজ করেন বলরামপুরে বাসিন্দা শফিক আলি। তিনিও এবার বাড়ি ফিরেছেন। আসার সময়ে ট্রেনে বসার জায়গাও পাননি। কোনোমতে কষ্ট করে দু’দিনের ট্রেন সফর শেষ করে বাড়িতে ফিরেও থাকতে পারবেন না দুই সপ্তাহ। শফিক আলি এবার কাজে নিয়ে যাবেন ছোট ছেলে মুস্তাকিন আলিকেও। কলেজ পড়ুয়া মুস্তাকিনের কথায়, ‘‘চাকরির পরীক্ষাও হচ্ছে না বেশ কয়েক বছর। তাই কিছু দিন বাইরে গিয়েই দেখি, যদি কোনও কাজ পাওয়া যায়।’’
গ্রামে উৎসবের আবহে চর্চার বড় বিষয় এখন কাজ আর রোজগার।
Comments :0