Migrant workers

অন্ধ্র থেকে ৬ পরিযায়ী শ্রমিককে উদ্ধার করে আনল সিআইটিইউ

জাতীয় রাজ্য

মধুসূদন চ্যাটার্জি: বাঁকুড়া 


দালাল মারফত অন্ধ্রের একটি অ্যাকোয়া ফার্মে কাজ করতে গিয়ে কার্যত দাসশ্রমিকে পরিণত হয়েছিলেন শালতোড়ার ৬ যুবক। মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে বহির্জগতের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ ছিন্ন করে প্রতিদিন ১২-১৩ ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়ে দু’বেলা নামমাত্র খাবার দেওয়া হতো। একটি ছোট ঘরে ঠাসাঠাসি করে তাঁদের থাকতে হচ্ছিল। 
সিআইটিইউ’র উদ্যোগে কার্যত বন্দি অবস্থা থেকে এই ৬ জন পরিযায়ী শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে অন্ধ্র প্রদেশের কাঁকিনাড়া জেলার পেড্ডাপুদির একটি অ্যাকোয়া ফার্মে। পরিযায়ী শ্রমিকদের সবার বাড়ি বাঁকুড়া জেলার শালতোড়া থানার গোগড়া গ্রামে। এঁরা হলেন সম্রাট বাউরি, স্বাধীন বাউরি, রাজীব বাউরি, সঞ্জয় বাউরি, তাপস (দীপক) বাউরি ও সমর বাউরি। এঁদের মধ্যে ৪ জনের বয়স ২৫-এর নিচেই। এই ঘটনায় এরাজ্যে কাজের আকালে বেকার যুবকদের ভিনরাজ্যে গিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হওয়ার চিত্রই আবার স্পষ্ট হয়ে উঠল।  
মঙ্গলবার উদ্ধার হওয়ার পর অন্ধ্র প্রদেশের সামালকোট স্টেশন থেকে ইস্ট কোচ এক্সপ্রেসে খড়্গপুর হয়ে তাঁরা বাঁকুড়া স্টেশনে পৌঁছালে সিআইটিইউ’র নেতা-কর্মীরা এই ৬ শ্রমিককে সংবর্ধনা জানিয়ে তাঁদের গোগড়া গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসেন। শ্রমিকরা বাঁকুড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে বলেন, লাল ঝান্ডা না থাকলে তাঁরা বেঁচে ফিরতেন না। সিআইটিইউ তাঁদের জীবিত ফিরিয়ে আনল। 


ঘটনা হলো, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক দালালের খপ্পরে পড়ে এই ৬ যুবক ট্রেনে চেপে কাজের জন্য অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপত্তনমে নামেন। সেই দালাল সেখান থেকে তাঁদের ট্রেনে সামালকোট স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখান থেকে অটোতে পেড্ডাপুদির সুধা সতীশ অ্যাকোয়া ফার্মে ঢুকিয়ে দেয়। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের বলা হয়েছিল, তাঁদের থাকার ভালো জায়গা দেওয়া হবে, দেওয়া হবে মাসে ১৫ হাজার টাকা মাইনে। ওই দালাল এঁদের ফার্মে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরই উধাও হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন থেকেই এই ৬ জনের উপর কাজের নামে অকথ্য অত্যাচার শুরু করে মালিকপক্ষ। তাঁদের বলা হয়েছিল, পুকুরে মাছের খাবার দেওয়ার জন্য তাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু সেই কাজ বাদ দিয়েও ফার্মের মধ্যে ঘাস কাটা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ এঁদের দিয়ে করানো হতো। ভোর ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এঁদের কাজ করতে হতো। পুকুরের মধ্যে ছোট্ট একটি ঘরে এই ৬ জনকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। দিনে দু’বার মাত্র খাবার দেওয়া হতো। অভ্যস্ত না থাকায় সেই খাবার তাঁরা খেতেও পারতেন না বলে জানিয়েছেন। 
এদিন সমর, সম্রাটরা জানালেন, তাঁদের ১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার কথা বলে নিয়ে গিয়ে ১২ হাজার টাকা দেবে বলে। আপত্তি জানালে মালিকপক্ষ হুমকি দেয়, বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। সবারই মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। বলা হয়, এভাবেই এখানে থাকতে হবে কমপক্ষে ৪ মাস। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কোনও দিন ছাড়া হবে না। প্রবল আতঙ্ক শুরু হয় তাঁদের মধ্যে। রাজীব বাউরি বললেন, এই অবস্থায় তাঁরা ৬ জন যাতে একসঙ্গে না থাকতে পারেন, তার জন্য সম্রাট ও স্বাধীনকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাতে তাঁদের মধ্যে আরও আতঙ্ক চেপে বসে। বাড়ির সঙ্গে তাঁরা কোনওভাবেই যোগাযোগ করতে পারেননি। অর্ধাহারে থেকে প্রায় এক মাস ১২ ঘণ্টা করে তাঁদের কাজ করতে হয়েছে। তাঁরা ভেবেছিলেন, বাড়িতে আর হয়তো ফিরতেই পারবেন না। 
এদিন ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কাস ইউনিয়নের রাজ্য নেতা উজ্জ্বল সরকার জানান, শালতোড়ার গোগড়া গ্রামে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারের লোকজন দিনের পর দিন এঁদের খোঁজ না পাওয়ায় স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কাছে যান। শাসক দলের নেতারা তাঁদের শালতোড়া থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে বলেন। তাঁরা শালতোড়া থানায় গেলে পুলিশ জানায়, তাদের কিছুই করার নেই। পরিবারের লোকজন অন্ধ্র প্রদেশে গিয়ে অভিযোগ করুক! এঁরা হতাশ হয়েই সিআইটিইউ’র বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক সৌমেন্দু মুখার্জিকে সব জানান। বিষয়টি তাঁর কাছে এলে তিনি অন্ধ্র প্রদেশ ও দিল্লির সিআইটিইউ এবং সংশ্লিষ্ট কাঁকিনাড়া জেলার সিআইটিইউ’র সম্পাদককে বলেন খোঁজ নিতে। সেখানকার সিআইটিইউ’র নেতৃবৃন্দ শ্রম কমিশনার ও কাঁকিনাড়া পুলিশ সুপারের কাছে লিখিতভাবে এই ঘটনা জানান। 
মঙ্গলবার সিআইটিইউ’র কাঁকিনাড়া নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পুলিশ ওই ফার্মে হানা দিয়ে ৬ জন পরিযায়ী শ্রমিককে উদ্ধার করে। প্রশাসন ও সিআইটিইউ’র চাপে ওই শ্রমিকদের এক মাসের বেতন মালিকপক্ষ দিতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি ওই শ্রমিকদের বাঁকুড়া পর্যন্ত আসার ভাড়াও দিতে বাধ্য হয় মালিকপক্ষ। 
উদ্ধার হওয়া ওই ৬ জন শ্রমিক জানালেন, স্থানীয় এলাকায় কোনও কাজ নেই। পাঁচ বছর হলো শালতোড়ার পাথর খাদান, ক্র্যাশার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নেই রেগারও কাজ। সংসারে নেমে এসেছিল গভীর সঙ্কট। তাই বাধ্য হয়েই কোনও কিছুর খোঁজ না করে তাঁরা চলে গিয়েছিলেন ওই দালালের কথায়। প্রাণটা নিয়ে কোনও মতে ফিরে এ‍‌সেছেন। তাঁরা আরও বললেন, ‘‘এখানেও কোনও কাজ নেই। আমরা বাঁচব কী করে বলতে পারেন?’’ 
এদিন উজ্জ্বল সরকার জানান, ভয়াবহ অবস্থা সব জায়গায়। বাঁকুড়া জেলা থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক বাইরে কাজ করতে গিয়েছেন। তাঁদের কোনও নিরাপত্তা নেই। সরকারকে এখানে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। এদিন সন্ধ্যায় সিআইটিইউ নেতৃবৃন্দ গাড়িতে করে এই ৬ পরিযায়ী শ্রমিককে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেন। গোগড়া গ্রামের মানুষের মুখেও হাসি ফোটে। ওই দালালের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। প্রশাসনিক স্তর থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবি জানানো হবে বলে সিআইটিইউ’র নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন। 
এদিন বাঁকুড়া স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন উজ্জ্বল সরকার, সিআইটিইউ নেতা প্রতীপ মুখার্জি, বিড়ি শ্রমিক নেতা ভৃগুরাম কর্মকার, মুটিয়া শ্রমিক নেতা তপন বাউরি, শেখ সহরাফ সহ কর্মীবৃন্দ। 

Comments :0

Login to leave a comment