Signature campaign

সইয়ের সঙ্গে সাহস নিয়ে ফিরছেন পার্টিকর্মীরা

রাজ্য

 কিছু অঞ্চলে বোঝানোর দরকার পড়ছে না। লিফলেট হাতে নিয়ে দাবিপত্রে সই করে দিচ্ছেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু সেই আলিপুরদুয়ারেরই কিছু অঞ্চলে গ্রামবাসীরা প্রশ্ন করছেন। কেন সই করব, কী কী দাবি তোমাদের — জানতে চাইছেন। সিপিআই(এম) কর্মীরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। তবে সই সংগ্রহ হচ্ছে।
কেন এমন? পার্টির আলিপুরদুয়ার জেলা কমিটির সম্পাদক কিশোর দাসের ব্যাখ্যায়,‘‘খবরের কাগজ পড়ে, টিভি দেখে কিংবা নিজেদের অভিজ্ঞতায় একাংশের মানুষ জানেন তৃণমূলের দুর্নীতির বিষয়ে। তাঁদের বিশেষ কিছু বলার দরকার পড়ছে না। কিন্তু কিছু অঞ্চলের মানুষ অতটা ওয়াকিবহাল নন। নিজেদের প্রাপ্য সম্পর্কেও তাঁরা অতটা সচেতন নন। তাঁরা জানতে চাইছেন বিস্তারিত। তাঁরা কিভাবে ঠকছেন, রাজ্যে কীভাবে দুর্নীতি হয়েছে, হচ্ছে কর্মীরা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। তবে সই সংগ্রহ করা যাচ্ছে।’’
চাকরির ক্ষেত্রে, গ্রামোন্নয়নসহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পে দেদার টাকা লুট করেছে তৃণমূল। শিক্ষাক্ষেত্রকেও বিধ্বস্ত করছে তারা। গরিবরা প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এসবের বিরুদ্ধে জনমত তীব্র হচ্ছে। রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন কোনও তদন্ত না করলেও আদালতের নির্দেশে সিবিআই এবং ইডি তদন্তে নেমেছে, কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলের বোঝাপড়ায় সেই তদন্ত দ্রুত এগচ্ছে না, দুর্নীতির মাথাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনমত সংগঠিত করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে গণস্বাক্ষর সংবলিত ডেপুটেশন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সিপিআই(এম)র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি। মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলন তুলে ধরতে একমাসব্যাপী সাক্ষর সংগ্রহ করে এক কোটি মানুষের সই সংগ্রহের লক্ষ্যে নেমেছে পার্টি এবং বামপন্থী গণসংগঠনগুলি। 
সেই কাজ রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলায় শুরু হয়ে গিয়েছে। কলকাতা শহরের বিভিন্ন এলাকাতেও তৃণমূলের চুরি লুটের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম)’র কলকাতা জেলা কমিটির তরফে পোস্টার মারা হয়েছে। চোর ধরো জেল ভরো, বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ করো, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমাও সহ বিভিন্ন দাবির কথা পোস্টারে তুলে ধরা হয়েছে। এলাকায় এলাকায় বাড়ি বাড়ি জনসংযোগের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কলকাতা জুড়ে প্রচার সংগঠিত হচ্ছে। মঙ্গলবার মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগান এলাকায় এক সমাবেশে তৃণমূলের চুরি, লুট, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে এককাট্টা হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। কলকাতা সহ জেলাগুলিতে সই সংগ্রহ করতেও নেমে পড়েছেন পার্টি কর্মীরা। নানা অভিজ্ঞতাও হচ্ছে তাঁদের।
যেমন ভাতার, মঙ্গলকোট, গলসীর মত এলাকা। কৃষিপ্রধান অঞ্চল। চাষের অবস্থা খুবই খারাপ। ফলে দুর্বিষহ অবস্থায় কৃষক। খেতমজুরও। পূর্ব বর্ধমানের খেতমজুর আন্দোলনের নেতা গণেশ চৌধুরির অভিজ্ঞতা,‘‘সাড়া পাচ্ছি সবার কাছেই। সই করব না — এমন বলছেন খুবই কম। কিন্তু গ্রামের গরিবদের মধ্যে উৎসাহ যেন বেশি।’’

বিস্তীর্ণ এই জঙ্গলমহল বিনপুর-২নং ব্লকের মধ্যে পড়ে। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া, অনুর্বর জমি, আদিবাসী নিবিঢ় গ্রামাঞ্চল। ভীমার্জুন, বিদরি, বাঁশপাহাড়ি, চাকাডোবার মত গ্রামে সাড়া যথেষ্ট। কৃষক আন্দোলনের নেতা ধর্মদাস সর্দারের কথায়,‘‘সন্দাপাড়ার দুটি গ্রামে কী শুনেছেন জানেন? রাঙামেটিয়ার কথা শুনুন। আমাদের সেখানকার লোক বলল, বাপু, তোমরা আরও বেশি বেশি আসো। কী অবস্থায় আমরা পড়েছি তো জানো। তোমরা ছাড়া কে আটকাবে বলো? তোমাদের জওয়ানদের আসতে বলো বেশি বেশি। গ্রামের সব লোক গোল হয়ে ঘিরে আমাদের কথা শুনলো। সই দিল।’’ 
সুন্দরবনের একটি দ্বীপাঞ্চল পাথরপ্রতিমা। বঙ্গোপসাগর লাগোয়া এই ব্লক ভারতের অন্যতম জলসীমান্তের এলাকা। এই দ্বীপের ব্লকটিতে ১১টি পঞ্চায়েত। প্রতিটি পঞ্চায়েতে সই সংগ্রহ চলছে। এখানকার রামগঙ্গা, বনশ্যামনগর, অচিন্ত্যনগরের এমন বেশ কয়েকটি বুথ আছে যেখানে মোট বাসিন্দার ৮০%-র কাছে পৌঁছেছেন পার্টিকর্মীরা ইতিমধ্যেই। এরিয়া কমিটির সম্পাদক সত্য দাসের কথায়,‘‘মানুষ এগিয়ে এসে সই দিচ্ছেন। সইয়ের সময় চলছে আলোচনাও। তৃণমূলের দুর্নীতি, চুরির বিরুদ্ধে তাঁরা এতটাই ক্ষুব্ধ যে, সেই সব পঞ্চায়েত তৃণমূলের হওয়া সত্ত্বেও তৃণমূলের কোনও নেতা বাধা দেওয়ার সাহস দেখাতে পারছেন না।’’ সাগরদ্বীপ, কাকদ্বীপ, নামখানা, ক্যানিং, বাসন্তির মত সুন্দরবনের ব্লকগুলিতেও সই সংগ্রহ চলছে। লক্ষ্যণীয় হলো, এই সংগ্রহের সময়েই স্থানীয় ইস্যুর কথাও মানুষ বলছেন। যেমন পাথরপ্রতিমা, সাগর, কাকদ্বীপে পার্টিকর্মীদের কাছে গ্রামবাসীরা বাঁধের দুরবস্থা, পানীয় জলের সঙ্কট, কাজের অভাবের কথাও বলছেন।
মানুষ তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন, তার প্রমাণ সাগরদিঘির বিধানসভা উপনির্বাচন। সিপিআই(এম)-র প্রতিটি জনসভায় উপচে পড়ছে মানুষের ঢল। সেই পরিস্থিতিতে দুর্নীতি, চুরির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের দাবিতে সিপিআই(এম)-র সই সংগ্রহে সাড়া পড়েছে যথেষ্ট। তবে কোনও কোনও এলাকায় গ্রামবাসীরা সই দেওয়ার পর এবং পার্টিকর্মীরা সেখান থেকে চলে আসার পর তৃণমূল গ্রামবাসীদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে— ‘‘সিপিএম’র পক্ষে গেলে কিন্তু কোনও ভাতা পাবে না।’’ তবে গ্রামবাসীদের মধ্যে তৃণমূল সম্পর্কে ভয় ভাঙছে। ফলে পার্টিকর্মীদের সঙ্গে নানা বিষয়ে নিজেদের অভাব অভিযোগ নিয়ে তাঁরা কথা বলছেন।
আর একটি বিষয় চোখে পড়ছে পার্টিকর্মীদের। গত নির্বাচনগুলিতেও যাঁদের মধ্যে বিজেপি’র প্রতি দুর্বলতা দেখা গিয়েছিল, তেমন মানুষও কথা বলছেন, শুনতে চাইছেন সই সংগ্রহের ইস্যু, পার্টিকর্মীদের কথা।
মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মত মুখ আর দেখা যাচ্ছে না!
সিঙ্গুরের কথাই ধরা যাক। হুগলী জেলার প্রতিটি ব্লকে সই সংগ্রহ চলছে। পার্টিকর্মীরা বাড়ি বাড়ি পৌঁছনোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারই মধ্যে খাসেরভেড়ি, সিংহেরভেড়ির কথা উল্লেখ্য। ২০১১-য় রাজ্যে তৃণমূলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওই গ্রামে সিপিআই(এম) প্রায় কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিই দীর্ঘদিন পরিচালনা করতে পারেনি।
সেই সব গ্রামেও সই সংগ্রহ চলছে।
পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ইতিমধ্যেই আশাপ্রকাশ করেছেন যে, লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি থাকলেও, স্বাক্ষরের সংখ্যা সেই লক্ষ্যমাত্রাকে ছাপিয়ে যাবে।
আলিপুরদুয়ার, বেলপাহাড়ি কিংবা পাথরপ্রতিমা— সেই আশা জোরদার করছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment