Rent Seeking Post Editorial

রেন্ট সিকিং তৈরি করছে দুর্বৃত্তায়ন

সম্পাদকীয় বিভাগ

Rent Seeking Post Editorial


গত কয়েকদিনে শিলিগুড়ির বেশ কয়েকজন মানুষের সাথে আমার কথা হচ্ছিল। এর মধ্যে তিনজন বেশ বিত্তশালী মানুষ। গত ১০ বছরে তারা তিনজনই হয়েছেন আরও বিত্তশালী। তিনজনই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের বেশ প্রশংসা করেছেন আমার কাছে। এর বড় কারণ একটাই। আজ আর শ্রমিকদের বা ট্রেড ইউনিয়নের নাকি বাড়াবাড়ি নেই। তারা যা বলেন ট্রেড ইউনিয়নগুলি তাই-ই নাকি মেনে নেয়। এই মানুষ‍‌দের কথায়, এতে শ্রম আইন বা তাদের কাজ সংক্রান্ত কোন আইন এখন আগের মতো মেনে চ‍‌লতে হয় না। কথা থেকেই বুঝতে পারলাম কোনও উৎপাদন বা সম্পদ সৃষ্টি নয়, তাঁরা তিনজনই অতিরিক্ত বিত্তের অধিকারী হয়েছেন কেবলমাত্র কিছু সম্পদ ট্রান্সফার বা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে। 
শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিঙ মেলে আসছিলাম শিলিগুড়ি। স্টেশনে নিয়েছিলাম একজন পোর্টার মালপত্র বহনের জন্য। পোর্টারকে ওর চার্জ মিটিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, দিনে তাঁর কত টাকা আয় হয়? ও জানালো ১০০০ টাকা আয় হলে ৭০০ টাকাই দিতে হয় বাবুলোককে। আমি তাকে বললাম পরিশ্রম করছো তুমি, আর একজন কিছু না করেই বেশিরভাগ টাকাটা নেবে কেন? সব টাকাটা তো তোমারই প্রাপ্য হওয়া উচিত। পোর্টারটি বলল শর্তে কাজ না করলে ‘মুঝে কাম সে নিকাল দেগা, বাহার বহুত আদমি বৈঠ রহা হয় কাম করনে কে লিয়ে।’ 
একটি জনসভার জন্যে কয়েকটি বস্তিতে গিয়েছিলাম প্রচারে। দেখেছি তাদের অনেকের চোখে, মুখে আতঙ্কের ভাব। তাদের ধারণা, আমরা এসেছি, ওরা দেখে নিলে এদের পাওয়া সুবিধাগুলি সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অনেক বস্তিতে দেখেছি ছোট ছোট দোকানের জন্য, বা করোনার সময় চিকিৎসার জন্যে অনেককে ঋণ নিতে হয়েছে। সেই ঋণ পরিশোধ করতে হয় সপ্তাহে সপ্তাহে। এছাড়াও অনেককে টাকা ধার নিতে হয় মহল্লার কিছু দাদাদের কাছ থেকেও। এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি বা পৌরসভা প্রকল্পের সামান্য কিছু সুবিধা পাওয়ার জন্যে বহু বস্তিবাসী নির্ভরশীল শাসক দলের ছোট বড় নেতাদের উপর। এই সমস্ত সরকারি প্রকল্পের সুবিধাগুলি পাওয়া যে তাদের অধিকার, এতো সব বোঝে না অনেকেই। অনেকে আবার জানে না বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধাগুলি পাওয়ার পদ্ধতিই বা কী, অনেককে আবার বোঝানো হয় সরকারি প্রকল্পের আর্থিক সহায়তা নিয়েও, কোনো কাজ না করেও কীভাবে বাড়তি টাকা উপার্জন করা যায়। তা প্রধানমন্ত্রীর গৃহ নির্মাণ বা‍‌ শৌচালয় নির্মাণ হোক, হোক কন্যাশ্রী বা রূপশ্রী প্রকল্পের টাকা। অনেকেই মনে করে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা, স্কুল-কলেজে ভর্তি, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, তফসিলি জাতির শংসাপত্র, বাড়িতে জলের লাইন, বিদ্যুতের লাইন, সবরকমের ভাতা সব কিছুই করে দিতে পারে শাসক দলের দাদারা। বিনিময়ে তাদের কিছু দিতে হবে। এইভাবে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের শাসনে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এক নতুন পলিটিক্যাল সোসাইটি বা রাজনৈতিক সমাজ। আর শহর বা শহরতলিতে এক সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ রয়েছে তারও নিয়ন্ত্রক এখন কিছু এলিটরা। সামাজিক হোক, হোক রাজনৈতিক, ক্লাব হোক, পূজা কমিটির পদাধিকারি হোক সব কিছুতেই শেষ কথা বলে থাকে এই নতুন প‍‌লিটিক্যাল সোসাইটি। পঞ্চায়েত হোক, হোক পৌরসভা, সব সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার মূল নিয়ন্ত্রক তারাই। শহর, শহরতলি, আধা শহর, এমনকি গ্রামেও, পশ্চিমবঙ্গে আজ দুটি শব্দ খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এক সিন্ডিকেট, দুই কাটমানি। আপনি যা কিছু নির্মাণ করুন, সম্পত্তি হস্তান্তর করুন— তা জমিই হোক বা বাড়িই হোক, সিন্ডিকেট বা কাটমানিকে এড়িয়ে কিছুই করতে পারবেন না। এসব অর্থ শাসক দলের ওপর থেকে নিচুস্তর পর্যন্ত সব ধরনের নেতৃত্ব পর্যন্ত যায়। আর তারই একটি অংশ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পৌঁছায় শহর বা গ্রামের একটি অংশের কিছু মানুষ পর্যন্ত। শহরের বস্তি বা গরিব মানুষদের একটি অংশকে শাসক দল ও সরকারের দয়া-দাক্ষিণ্য, অনুকম্পা চুঁইয়ে পড়া অর্থের ওপর এভাবে নির্ভরশীল করে দেওয়া হচ্ছে। নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে শ্রেণি চেতনা বোধ, প্রতিবাদী মানসিকতা। উৎসাহিত করা হচ্ছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মৌলবাদ ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে ভাগ ও বিভাজনকে, পরিচিতিসত্তার রাজনীতিকে। নব্য উদারীকরণ আর্থিক নীতির ফলেই কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার তলানিতে পৌঁছেছে। কৃষিক্ষেত্র অবক্ষয়িত হচ্ছে, অর্থনীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে অনুৎপাদনশীলতা এসব কথা বুঝতে দেওয়া হয় না এই গরিব মানুষদের। আমরা জানি রাজনৈতিক-অর্থনীতির চিরায়ত অর্থে, উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদিকা শক্তির কথা। আমরা এও জানি মানুষের বিকাশ, সমাজের বিকাশ, সভ্যতার বিকাশ কোনও অনড় বিষয় নয়। তা সদা পরিবর্তনশীল। আমরা সবাই জানি পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় খাটিয়ে, শোষণ করে শ্রমিকদের প্রাপ্য শ্রমের মূল্য দেয় না। তার থেকে তারা সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা। যাকে বলা হয় উদ্বৃত্ত মূল্য।
এখানে আমি যা বলতে চাইছি, তা হলো রেন্ট সিকিং-এর কথা। যার আক্ষরিক বাংলায় অর্থ ভূমি খাজনা হলেও, ইংরেজিতে রেন্ট সিকিং প্রতিশব্দই আমি ব্যবহার করছি। আসলে কোনও মানুষ বিত্তশালী হতে পারে দুইভাবে। এক, কোনও সম্পদ সৃষ্টি করে, আবার কোনও সম্পদ সৃষ্টি না করেও,  প্রথমজন উৎপাদন করে এবং উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়জন কোনও সম্পদ সৃষ্টি না করে, উৎপাদন না করে, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, হরণ, অধিগ্রহণ, লুট, জবরদখলের মাধ্যমে বিত্তশালী হয়ে থাকে। প্রথমটির মধ্য দিয়ে সমাজের বিত্ত বৃদ্ধি পায়, দ্বিতীয়টি, সমাজের বিত্ত কমায়। প্রথমটির সাথে উৎপাদনের সম্পর্ক থাকে, দ্বিতীয়টির সাথে উৎপাদনের কোনও সম্পর্ক থাকে না। এই দ্বিতীয়টিকেই বলা হয় রেন্ট সিকার বা রেন্ট সিকিং। রেন্ট শিকারীদের বলা যেতে পারে অনুপার্জিত আয়কারী, পরজীবি শ্রেণি, আত্মসাৎকারী, লুটেরা। আগেই বলা হয়েছে রেন্ট সিকাররা উৎপাদন করে না, সম্পদ সৃষ্টি করে না, এরা শুধু সম্পদ হস্তান্তর করে। তা দৃশ্যমান হতে পারে, হতে পারে অদৃশ্যমানও। এরা কোনও কিছুই করতে পারে না, সরকার ও শাসক দলের সাথে সুসস্পর্ক না রেখে। রেন্ট সিকার, রাজনীতি, সরকার একটি ত্রিভূজ। এদের ক্ষেত্রে বহু সরকারি আইন, বিধি, নিয়ম কার্যকরি হয় না। যেকোনও প্রতিযোগিতামূলক বিডিং-এর বাইরে রাখা হয় এদের। প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ, জলজ, ভূমিজ সম্পদ লুট করতে, এদের সহায়তা করে রাষ্ট্র বা সরকার। এমনকি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণের টাকাও এদের যাতে পরিশোধ করতে না হয়  তার জন্যেও নানা রকমের সহায়তা পায় এরা, সরকারের কাছ থেকে। রেন্ট সিকাররা নানা ফন্দি ফিকির করে বিভিন্ন সাবসিডি বা ভরতুকি হাতিয়ে নেয়। এর থেকে কোনও সম্পদ তারা সৃষ্টি করে না। ধ্রুপদী অর্থনীতিতে আমরা জানি, পুঁজির বিনিয়োগ ও ঝুঁকি ছাড়া মুনাফা সৃষ্টি করে না। রেন্ট সিকিং হচ্ছে সব চাইতে সহজভাবে অর্থ রোজগারের একটি পথ। যার জন্য উৎপাদন বা বিনিয়োগের দরকার নেই, কোনও শ্রম ও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন নেই, নেই কোনও পুঁজি বিনিয়োগের ঝুঁকিও। রেন্ট সিকিং সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও মৌলবাদ সৃষ্টির সহায়ক। এই ব্যবস্থা অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের সৃষ্টি করে। অর্থনীতিকে করে অস্থিতিশীল। বৃদ্ধি করে অসমতা ও বৈষম্যকে। শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণি-চেতনা বৃদ্ধি ও সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ হতে এরা বাধা সৃষ্টি করে থাকে। এদের লক্ষ্য অসংগঠিত ক্ষেত্র এবং শহর, শহরতলি, আধা-শহরের বস্তিবাসী, গরিব ও তরুণ প্রজন্মকে ব্যবহার, অপব্যবহার ও বিভ্রান্ত করা। এরা শাসক গোষ্ঠীকে তাদের স্বার্থবাহী একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তলতে সহায়তা করে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে সৃষ্টি করে অবক্ষয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদী মানসিকতা, সংবেদনশীলতাকে দুর্বল করে। এমন একটি পরিবে‍‌শের সৃষ্টি করা হয়, যাতে শত অন্যায় দেখেও গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষরা নীরবে সবকিছু সহ্য করতে অভ্যস্ত হয়। সরকারের যে-কোনও জনবিরোধী নীতি ও কার্যকলাপের প্রতি এইসব মানুষরা দিয়ে থাকে নীরব সম্মতি। 


এক দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস দল ক্ষমতাসীন। পর পর তিনটি বিধানসভা নির্বাচনে তারা জয়লাভ করেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন ব্যতীত, ২০১১ সালের পর থেকে এরাজ্যে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনই তাদের ভোট ও আসন প্রাপ্তির হার ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে তাদের ভোটপ্রাপ্তির হার গ্রাম ও শহরের গরিবদের মধ্যে বেশি। অথচ ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের অনেক রাজ্য থেকে বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি অনেক কম। যে সামাজিক ক্ষেত্রের মাথাপিছু ব্যয়বৃদ্ধি নিয়ে বর্তমান রাজ্য সরকার বড়াই করে থাকে সেই ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের স্থান জাতীয় হার থেকে অনেকটা কম। এনএসএসও’র রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান রাজ্য সরকারের প্রথম ১০ বছরের সাফল্য বিগত বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দুই দশক থেকে অনেক কম। পশ্চিমবঙ্গে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের গতি বৃদ্ধির হার ১৯৯১-২০০০ এবং ২০০১-২০১০ সালে যথাক্রমে ছিল ৪.৯ শতাংশ এবং ৫.৪ শতাংশ। অথচ ২০১১-২০১৯—এই ৯ বছরে যখন রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ছিল, তখন রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৪.০ শতাংশ। যদি ক্ষেত্রভিত্তিক বৃদ্ধির হারের দিকে আসা যায় তবে দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯৪-২০০০ এবং ২০১০ সাল যখন রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ছিল, তখন কৃষিতে বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৪.২ শতাংশ এবং ২.৪ শতাংশ। শিল্পে এই হার ছিল ৭.৩ শতাংশ এবং ৭.১ শতাংশ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই হার ছিল জাতীয় হারের ঊর্ধ্বে। ২০১২-২০২০ সে সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। তখন কৃষি, শিল্প,  পরিষেবায় গতি বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৩.৩ শতাংশ, ৬.৬ শতাংশ এবং ৬.৫ শতাংশ। একমাত্র কৃষিক্ষেত্র ব্যতীত এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক বৃদ্ধির হার বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দুই দশক থেকে ‍‌ছিল কম। শহর ও গ্রামে বেকারির হার ২০০৯-২০১০ সালে ছিল যথাক্রমে ৪ শতাংশ এবং ১.৯ শতাংশ। 

 

২০১৭-২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে যখন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে বেকারির হার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির সার্বিক অগ্রগতি নয়, অবনতি হয়েছে। উৎপাদনশীলতা নয়, অর্থনীতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে অনুৎপাদনশীলতা। এখনও পশ্চিমবঙ্গের রোজগারের সব চাইতে বড় ক্ষেত্র, কৃষির  পরে অসংগঠিত ক্ষেত্র। বিগত ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গে শহর ও গ্রাম—উভয় ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারি। এই সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে সিন্ডিকেট, কাটমানি, বড় বড় দুর্নীতি, বেআইনি পথে রোজগার, জমির দালালি, প্রাকৃতিক সম্পদের লুট, সরকারি প্রকল্পগুলির অপব্যবহার। পশ্চিমবঙ্গে শহর বা  গ্রামে শাসকদলের নেতৃত্বের তোলাবাজির, দাদাগিরি, মাফিয়াগিরি, মাতব্বরি ছাড়া বর্তমানে কোনও কাজ হতে পারে না। এর সাথে আছে পুলিশের হুমকি। রাস্তার ধারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা হকার  হোক, হোক অটো-টোটো, রিকশাচালক বা কোনও নির্মাণ শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের  শ্রমিক, সবাইকেই থাকতে হয় এই পলিটিক্যাল সোসাইটির ভয়-ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে। গরিব মানুষের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনের ভিত্তি তাদের সংগঠন বা মতাদর্শ নয়, তাদের সমর্থনের মূল ভিত্তি ইন্টিমিডিশন বা ভয়ভীতি। তাদের সাথে না থাকলে কেড়ে নেওয়া হতে পারে তাদের প্রাপ্য সামাজিক সুরক্ষাভাতা, বাড়ি নির্মাণের অর্থ, তার সাথে নানা ধরনের সম্পদ হস্তান্তর বা বেআইনিভাবে পাওয়া আদায়ীকৃত অর্থের ভাগও। এসবই রেন্ট সিকিং-এর অর্থনীতির পরিণতি। এর প্রভাব পড়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। রেন্ট সিকিং থেকে দুর্নীতিকে বিযুক্ত করা যায় না। আজ পশ্চিমবঙ্গে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির ‍‌পিছনে রয়েছে এই রাজনীতির একটি বড় ভূমিকা। রেন্ট সিকিং মানে সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতি। অপচয় শ্রম শক্তিরও। 
নব্য-উদারীকরণ অর্থনীতির যুগে শহর বা আধা-শহরে জমিই পরিণত হচ্ছে সবচাইতে বড় মূল্যবান সম্পদে। তাকে কেন্দ্র করে হচ্ছে রেন্ট-শিকারিদের বাড়বাড়ন্ত। অনেক গরিব ও বস্তিবাসী আজ এই রাজনৈতিক সমাজের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এটা ঠিক গ্রামের মানুষের কাছে রোজগার সৃষ্টিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ১০০ ‍দিনের কাজের প্রকল্পের রয়েছে ‍বিশেষ গুরুত্ব। গরিব গ্রামবাসীরা তা দ্বারা যেমন  উপকৃত হয়ে থাকেন, তেমনি এই প্রকল্পে গ্রামবাসীদের অন্যান্য প্রকল্পেও মজুরি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনাও এইরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় প্রকল্প। তৃণমূল কংগ্রেস দলের দ্বারা পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি প্রকল্পটিকে নিয়ম মতো পরিচালনা না করে সৃষ্টি করেছে ব্যাপক দুর্নীতি। কোনও সম্পদ সৃষ্টি না করে কোনো শ্রম না দিয়েই রেগা প্রকল্পে তারা জবকার্ড সংগ্রহ করে কর্মহীন গ্রামবাসীদের সামান্য অর্থ দিয়ে বাকি অর্থ রেখে দিচ্ছে শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্ব। এই অর্থের অংশ যায় দলীয় উচ্চস্তর পর্যন্ত। 

 

এই দুর্নীতির ফলে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামের কর্মহীন গরিব মানুষেরা। কার্যত তাঁদের প্রাপ্য মজুরি এবং সম্পদের অর্থ লুটে নিচ্ছে শাসকদলের ‍‌কিছু মাফিয়া বা দাদারা। এটিও এক ধরনের রেন্ট সিকিং। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলে সৃষ্টি করা হয়েছে এক ধরনের স্থানিক প্রভুত্ব। এই প্রভুত্ব সৃষ্টি করেছে  রাজ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য। উদ্বেগের বিষয় হলো এই সমস্ত গরিব মানুষদের ওপর নানাভাবে রাজ্যের শাসকদল যে আধিপত্য সৃষ্টি করে, ভয়-ভীতি ও চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করছে, তাও একটি বড় সামাজিক ক্ষতি। শহর ও গ্রামীণ সর্বহারাদের ক্রমেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একটি আন্ডার ক্লাসের দিকে। যাতে তাঁরা সচেতন হয়ে শ্রেণি হিসাবে  সংগঠিত হতে না পারে। 

 


শিলিগুড়ি এমনই একটি উঠতি মেট্রো শহর। যতই এই শহরে বসবাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়ছে। ততই জমির চাহিদা ও মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। এই জমিকে নিয়েই চলছে এই শহর ও শহর-সংলগ্ন আধা-শহর এলাকায় এক শ্রেণির জমির কারবারীদের সক্রিয়তা ও তৎপরতা। তারাই এই সমস্ত এলাকার রাজনৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রকে পরিণত হ‍‌চ্ছে। এরা সহায়তা পাচ্ছে শাসক রাজনৈতিক দল, পুলিশ-প্রশাসনের। শহরে বৃদ্ধি পাচ্ছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। শহরের বস্তি ও সংলগ্ন গ্রামগুলিতে পড়ছে তার প্রভাব। শহরের এক ‍‌শ্রেণির এলিটরা উন্নয়ন ও পুনঃউন্নয়নের নামে বস্তিবাসী ও গরিবদের স্বার্থের বিনিময়ে বিত্তশালী হচ্ছে। তারা শহরের এ‍‌ই সমস্ত গরিব মানুষদের নানা প্রলোভনের মাধ্যমে ব্যবহার বা অপব্যবহার করছে। অথচ এভাবে যে বস্তিবাসীদের বা গরিবদের মধ্য থেকে দারিদ্র প্রশমিত করা যায় না, তারা তা বুঝতে পারছে না। এখানেই আমাদের নিতে হবে বড় দায়িত্ব। এই সমস্ত গরিব মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের রয়েছে অনেক মৌলিক সমস্যা। এসব নিয়ে আমাদের জনমত গড়ে তুলতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় শহরের মতো শিলিগুড়ি শহরেও আজ এই সমস্ত জমির দালাল আর প্রোমোটাররা এক ফাটকা খেলায় মেতে উঠেছে, যা সৃষ্টি করছে এক আর্বান ক্যাপিটাল অ্যাকুমুলেশন বা শহর এলাকায় পুঁজির সঞ্চয়। তারা যা করে, তা করে বেআইনি ও অনৈতিক পথে। কেউ কেউ মনে করে এদের এই কার্যকলাপে শহরের বস্তিবাসী বা গরিবদের কিছু রোজগার তো হচ্ছে। অথচ তারা যা করছে, তা করছে আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের আরও দরিদ্র ও বঞ্চিত করে। এইভাবে একদিকে বিত্তশালীরা আরও বিত্ত বৃদ্ধি করে, যাকে বলা হচ্ছে অ্যাকুমুলেশন বাই ডিজপসেশন, অন্যদিকে বহু বস্তিবাসী ও গরিব শহরবাসীদের এইভাবে নব্য উদারীকরণ আর্থিক নীতির কাছে চাপ সৃষ্টি করে আত্মসমর্পণ করানো হচ্ছে। শহর এলাকায় নব্য উদারীকরণ আর্থিক নীতি কার্যকরী হচ্ছে তথাকথিত রি-ডেভেলপমেন্ট ও রি-সেটেলমেন্ট-এর নামে। যার মূল কথা হলো প্রোডাকশন লেস স্পেস বা আরও স্থানের সৃষ্টি। বস্তিবাসী বা শহর বা শহরতলির গরিব মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে একদল নব্য বিত্তশালীদের এই সমস্ত অন্যায় ও অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে। এই লড়াই সার্বিকভাবে নব্য উদারীকরণ আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই সাথে হবে সাযূজ্যপূর্ণ। আর্বান ইনফর্মালিটি ও রেন্ট সিকিং একে অপরের পরিপূরক।
 

Comments :0

Login to leave a comment