HINDENBURG SC CORPORATE

লুটের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পেতে সরকার বদল জরুরি

জাতীয়

শ্রুতিনাথ প্রহরাজ
আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম অনৈতিক উপায়ে বৃদ্ধি সংক্রান্ত কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করে সেবির তদন্তের ওপর আস্থা রেখেছে শুধু তাই নয়, হিন্ডেনবার্গ সংস্থা এ বিষয়ে আইনানুগ তদন্ত করেছে কিনা এবং তা করে না থাকলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশও দিয়েছে। উচ্চ আদালতের এই রায় থেকে একটা বার্তা পরিষ্কার— এদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের বেপরোয়া লুট ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা যদি এ নিয়ে মুখ খোলে তাহলে তারও নিস্তার নেই। ঠিক যেভাবে এই ঘটনায় টার্গেট করা হয়েছে হিন্ডেনবার্গ সংস্থাকে। সঙ্গত কারণে অনেকেই এই রায়কে ‘হতাশাজনক’ বা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তবে গত তিন দশকে উদার অর্থনীতির পথ ধরে গড়ে ওঠা ধান্দার ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, এদেশে সরকারি মান্যতায় যে অবাধ লুটের কারবার চলছে, তার ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে এই রায়কে খুব অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হওয়ার কথা নয়। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে নস্যাৎ করে তাদের সম্পদ যখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় লুট হতে শুরু করে, তার বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত বা ন্যায়বিচার আশা করাটাই অর্থহীন। কারণ এক্ষেত্রে রক্ষকই প্রকারান্তরে ভক্ষকের ভূমিকা নেয়। তাই, দেদার লুট চলছে, চলবেও আগামী দিনে। সব দেখেশুনে খেপে উঠলেও মুখ খোলা চলবে না— এটাই ক্রমশ দস্তুর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি সংসদে এ নিয়ে প্রশ্ন করলেও চরম শাস্তির মুখে পড়তে হচ্ছে নির্বাচিত সাংসদদের। সামগ্রিক এক লুটের আবহকে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলে মানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

 গতবছর জানুয়ারি মাসে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর অনেকে ভেবেছিলেন আদানি গোষ্ঠী বোধহয় বড়সড় কোনও শাস্তির মুখে পড়তে চলেছে। কারণ, এভাবে মরিশাস সহ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের করমুক্ত দেশগুলিতে নিজের পরিবারের মানুষদের দিয়ে সেল (ভুয়া) কোম্পানি তৈরি করে তার মাধ্যমে এদেশে আদানি গোষ্ঠীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলির শেয়ারের কেনা বেচার মাধ্যমে শেয়ার দর কৃত্রিমভাবে প্রায় আশি থেকে একশো শতাংশ বাড়িয়ে তোলা চরম আর্থিক অপরাধ। যদিও ফাটকাবাজি এখন এদেশে আইনানুগ বৈধ, তবে এ তো শুধু ফাটকাবাজি নয়, আইনের সুযোগ নিয়ে একপ্রকার প্রকাশ্যে লোক ঠকিয়ে জোচ্চুরি বা লুট। ফলে শাস্তি তো পাওয়ারই কথা। একমাত্র  আদানিরাই জানতো শাস্তি পাওয়া তো দূরের কথা, ওদের টিকিও কেউ ছুঁতে পারবে না। কারণ আমরা এখন আদানি এবং আম্বানি নির্ভর ভারতের অধিবাসী, মুখে যতই আত্মনির্ভর বলা হোক না কেন। এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। প্রত্যক্ষ দান বা ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে গোপন দান— এসবেরই তো পূর্বশর্ত হলো গোপনে নয়, রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেদার লুটের লাইসেন্স নেওয়া। দেবে আর নেবে, মোদীরাজে তো এটাই দস্তুর। তাই ওদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি। উলটে এত বড় জোচ্চুরি প্রকাশ্যে আসার পর তার বিরুদ্ধে আদানি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে যখন সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়, পিছনে সচেতনভাবে ভারতের জাতীয় পতাকা লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। সচেতনভাবেই আদানি গোষ্ঠীর আর্থিক কর্ণধার জাতীয়তাবাদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে বারবার এটা বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন, হিন্ডেনবার্গ সংস্থা আদতে আদানিকে আক্রমণ করার নামে ভারতবর্ষকে আক্রমণ করেছে। কিভাবে আদানি পরিবার ও ভারতবর্ষ সমার্থক হয়ে দাঁড়ালো বা এই অধিকার তাদের কে দিল তার ব্যাখ্যা অবশ্য উনি দেননি। ওদের এই জোচ্চুরির দায় দেশ নেবে কেন এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। কেনই বা ওই সাংবাদিক সম্মেলনে মঞ্চের পেছনে ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা রাখা হয়েছিল তার খোঁজ কেউ নেয়নি। কার্যত তখনই বার্তা ছিল, এ নিয়ে ন্যায়বিচার চাইতে গেলে বা নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করলে আদালতের রায় কি হতে পারে। হয়েছেও তাই যা হওয়ার ছিল। 
মোদি জমানায় রাষ্ট্রের সখ্যে আদানি সাম্রাজ্যের উত্থান অতীতের সব নজিরকে ছাপিয়ে গেছে। তিন বছরে গৌতম আদানি শুধু শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি করে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ আট লক্ষ কোটি টাকার নিট সম্পদ বাড়য়ে নিতে পেরেছে। আম্বানিদের সম্পত্তিও বিপুল পরিমাণ বেড়েছে এই সময়ে, তবে আদানিরা কেন্দ্রের শাসক দলের সৌজন্যে শুধু ভারত নয় এই উপমহাদেশের ধনীতম পরিবারে পরিণত হয়েছে। সামান্য হিরে ব্যবসায়ী থেকে এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ সম্পদশালী পরিবার আদানি গোষ্ঠী। আদানি এন্টারপ্রাইজ যার শেয়ার মূল্য ২০১৪ সালে ছিল ৫১.২৮ টাকা, মোদী জমানায় গত ১০ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১৮৯.৫৫ টাকায়। হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের কল্যাণে অধুনা তা কমে ৩০০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। একইভাবে আদানি পোর্টসের ৩১৮ টাকার শেয়ার গত দশ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১১৭ টাকায়। আদানি গ্রিন কোম্পানির শেয়ারের দাম ১৬৪ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০৪৮ টাকায়। হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের ধাক্কায় এখন তা কমে ১৭০০ টাকার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। আদানি পাওয়ারের শেয়ার দাম ৬১ টাকা থেকে বেড়ে ৫৫৬ টাকা হয়েছে। এই সব ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার দেখলে বোঝা যায় কতটা অস্বাভাবিক হারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আদানি গোষ্ঠীর সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলির দৈনন্দিন অবস্থার সাথে তাদের শেয়ার বাজারের এই ওঠা পড়ার সম্পর্ক ছিল খুবই সামান্য। সবটাই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ভুয়া কোম্পানিগুলিকে কাজে লাগিয়ে, আমজনতার সম্পদ লুট করবার লক্ষ্য নিয়ে। সরকার বা শাসকদলের সমর্থন না থাকলে কোনও কর্পোরেট গোষ্ঠীর এতটা বেপরোয়া হয়ে লুট করবার সাহস থাকার কথা নয়। পরবর্তীকালে আদানিদের হুমকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিন্ডেনবার্গ সংস্থাই দেখিয়েছে কিভাবে আদানি গোষ্ঠী নিজেদের এইসব কুকর্ম আড়াল করতে উইকিপিডিয়ায় উল্লিখিত কোম্পানির রিপোর্ট বারংবার বদলেছে। ২০১৬ সালেই আদানিদের এই অস্বাভাবিক উত্থান নিয়ে অভিযোগ জমা পড়েছিল সেবির কাছে। আজ অবধি তার কোনও যথাযথ তদন্ত হয়নি। কখনো বলছে অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে আবার কখনো বলছে এই অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই। আসলে এ নিয়ে সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে— এমন অভিযোগও এসেছে জনসমক্ষে। অর্থাৎ সেবির অধিকর্তাদের এমন কেউ ছিলেন বা এখনো আছেন, যিনি আদানি গোষ্ঠীর ‘বিশেষ স্বার্থের সাথে যুক্ত ব্যক্তি’ হিসাবে চিহ্নিত। যদি এই অভিযোগ সত্য হয় তাহলে সেবির তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। সর্বোচ্চ আদালত সেই সেবির উপরেই তদন্তের ভার সঁপেছে। ফলে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে।
দিনের পর দিন মিথ্যাকে আশ্রয় করে আদানিরা তাদের সম্পদ বাড়িয়েছে। বিনিয়োগকারীদের তারা বলেছে ব্যাংকের সব ঋণ শোধ করা হয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে এটি সত্য নয়। কারমাইকেল কয়লা খনি কেনবার জন্য তারা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া থেকে প্রায় ২২৭৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বেমালুম চেপে গেছে। নথিভুক্ত এবং ভুয়া কোম্পানিগুলির মধ্যেকার আর্থিক লেনদেনের কোনও প্রকাশ্য হিসাব না থাকায় জোচ্চুরি আড়াল করা সম্ভব হয়েছে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে উল্লেখ ছিল, আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানির ভাই বিনোদ আদানি যুক্ত ছিল এক ডজনেরও বেশি ভুয়া কোম্পানিতে যেগুলির মাধ্যমে শেয়ার দরের বৃদ্ধির এই আর্থিক কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়েছে। তখন আদানি গোষ্ঠী এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছিল বিনোদ তাদের কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যুক্ত কেউ নয়। সংবাদ মাধ্যমের তদন্তে বেরিয়ে আসে বিনোদ আদানি এই গ্রুপের কোম্পানিগুলির দৈনন্দিন কাজের সাথে ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসাবে ভালোভাবেই যুক্ত। অম্বুজা সিমেন্ট এবং এসিসি কোম্পানি আদতে বিনোদ আদানির সংস্থাই অধিগ্রহণ করেছে। আসল সত্য বেরিয়ে আসার পর ক’দিন বাদে ওরাই আবার ডিগবাজি খেয়ে ঘোষণা করে, বিনোদ আদানি হলেন আদানি গোষ্ঠীর অন্যতম উদ্যোক্তা বা কর্ণধার। হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট যে সত্য তা পুনরায় প্রমাণিত হয়। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক তাদের তদন্ত আইনানুগ হয়েছে কিনা তা ভবিষ্যৎ বলতে পারবে, কিন্তু এই তদন্তের মাধ্যমে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির যে অভিযোগগুলি উঠে এসেছে তার যে সারবত্তা আছে এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।

২০২০ সালে ওরা ঘোষণা করেছিল দেশীয় কয়লা খনিগুলির উত্তোলন সংক্রান্ত নিলামে আদানি গোষ্ঠী আর আগ্রহী নয়। বাস্তবে দেখা গেল, ওরাই সবচাইতে বেশি নিলামে অংশ নিয়ে দেশের ১২ টি গুরুত্বপূর্ণ কয়লা খনির মালিকানা কিনে নিয়েছে। এই মুহূর্তে আদানিরা শুধু এদেশের নয়, বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি খনিজ কয়লা সম্পদের উত্তোলন ও উন্নয়নের মালিক। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে কারমাইকেল কয়লা খনি নেওয়ার সময় আদানিরা দাবি করেছিল, সেখানে দশ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। পরে দেখা গেল ১৫০০ লোকের বেশি নিযুক্তি হয়নি। এই মিথ্যাচারের জন্য অবশ্য ওদের শাস্তি পেতে হয়নি। শুধু তাই নয়, আদানি গোষ্ঠী প্রায়শই দাবি করে, ওরা নাকি পরিবেশবান্ধব সংস্থা। বাস্তবে দেখা গেছে কয়লার  উত্তোলনের ক্ষেত্রে বা বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকাঠামো নির্মাণের প্রশ্নে ওরা সর্বত্র নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও মালদা জেলায় মাইলের পর মাইল আমবাগান ওরা একই কায়দায় তছনছ করে দিয়েছে। সব ক্ষেত্রেই সরকার পেছনে থাকায় এই কাজ তারা বিনা বাধায় করতে পেরেছে।

উদার অর্থনীতির জমানায় এদেশে এ ধরনের ছোট বড় বেশ কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। কোনও ক্ষেত্রেই সরকার দুর্নীতিগ্রস্তকে আড়াল করতে প্রকাশ্যে ওকালতি করেনি ঠিক যেমনটা লক্ষ্য করা গেল আদানি গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে। ১৯৯২ সালে হর্ষদ মেহতার শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে যেখানে একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে কাজে লাগিয়ে বাজারদরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছিল। কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পর এক ধাক্কায় বিনিয়োগকারীরা প্রায় চার হাজার কোটি টাকার লোকসানের মুখোমুখি হয়। হর্ষদ মেহেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারে তার পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ১৯৯৮-২০০১ সালে ‘কে-১০ স্টক কেলেঙ্কারিতে’ ধরা পড়ে কেতন পারেখ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল একইভাবে কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানির ( কে-টেন কোম্পানি নামে পরিচিত ছিল) শেয়ার দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেখানো। ধরা পড়ার পর বিনিয়োগকারীরা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়ে। সেবি কেতন পারেখকে ১৪ বছরের জন্য শেয়ার বাজার থেকে বহিষ্কার করে। একই সাথে তার জেল জরিমানা দুই হয়। ২০০২ সালে স্ট্যাম্প পেপার কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়ে আব্দুল করিম তেলগি। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার এই আর্থিক কেলেঙ্কারি চলছিল ১৯৯২ থেকে প্রায় দশ বছর। ধরা পড়ার পর তেলগিকে ৩০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
২০০৯ সালে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার সত্যম কম্পিউটার কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। হিসাবের জালিয়াতি করে ফেক মুনাফা দেখিয়ে কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ানো হয়। একইভাবে বিনিয়োগকারীরা লোকসানের মুখে পড়ে। ধরা পড়ার পর কোম্পানির মালিক বি রামলিঙ্গ রাজু সহ আরও দশ জনকে সর্বোচ্চ আদালত দোষী সাব্যস্ত করে।

কিং ফিশার এয়ারলাইনসের মালিক বিজয় মালিয়া ২০১৬ সালে নিরাপদে দেশ ছেড়েছেন ব্যাংকের প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ রেখে। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ রেখে ২০১৮ সালে নিরাপদে দেশ ছেড়েছেন নীরব মোদী। এদের দেশে ফেরানোর এবং শাস্তি দেওয়ার কোনও উদ্যোগ সরকারের নেই। উলটে আমজনতার আমানতের অর্থ থেকে নেওয়া এইসব বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ ‘কুঋণ’ হিসাবে চিহ্নিত করে মুকুব করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মুছে ফেলছে (রাইট অফ) এই ঋণ ব্যাংকের খাতা থেকে। এ আরেক ধরনের প্রকাশ্যে লুট, যার মুখোমুখি হতে হয়েছে দেশের মানুষকে গত দশ বছরে। আমার আপনার হাজার হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়ী আমানত সরকারি বদান্যতায় জোচ্চোর কর্পোরেট মালিকদের সেবায় লাগানো হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে লোকসানের মুখে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলি।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১৩ সালে ধরা পড়ে সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি যেখানে অনুমান করা হচ্ছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ১৭ লক্ষ আমানতকারীর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই টাকা আর আমানতকারীরা ফেরত পাননি। মানসিক যন্ত্রণায় কয়েকজন এজেন্ট ও আমানতকারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। রাজ্যের সরকার ও শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের নেতাদের কুকীর্তিকে আড়াল করতে এই ঘটনার তদন্ত করতে চায়নি। উলটে বাম আমলের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা চলেছে। আদালতের বিচারাধীন হওয়ার পর এই ঘটনার মূল অভিযুক্ত সারদা গ্রুপের মালিক ও তার সহকারী এখন জেলবন্দি। একইভাবে রোজভ্যালি, এমপিএস সহ একাধিক চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে যেখানে লক্ষ লক্ষ আমানতকারীর স্বল্প সঞ্চয়ের অর্থ বেমালুম গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। এই প্রত্যেকটি চিট ফান্ডের লুট শুধু পশ্চিমবঙ্গের সীমানার মধ্যে আটকে নেই— আসাম ত্রিপুরা ওডিশা সহ অন্যান্য রাজ্যেও সংগঠিত হয়েছে। ফলে সর্বস্বান্ত হয়েছেন বহু দরিদ্র মানুষ। আদালতের নির্দেশে এদের মালিকরাও এখন জেলে এ কথা ঠিক, তবে কবে এইসব লুটেরার দল শাস্তি পাবে বা আদৌ শাস্তি পাবে নাকি সরকারি বদান্যতায়  সসম্মানে মুক্তি পাবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে লুট চলছে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মন্ত্রীদের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি যা ক্রমশ ধরা পড়ছে, তাও এই ব্যবস্থার অঙ্গ বলা যেতে পারে। জনগণের অর্থ, সম্পদ, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার নির্বিচারে লুট করছে শাসকদলের নেতা মন্ত্রীরা। রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের সীমানা জুড়ে ধান্দার ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মান্যতায় দেদার লুটের বন্দোবস্ত ক্রমশ বাড়ছে। ভুলে গেলে চলবে না রাষ্ট্র যখন লুটের মান্যতা দেয়, সাধারণ মানুষ হারায় তার মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার। আইনসভা, প্রশাসনের পাশাপাশি বিচারব্যবস্থাও যদি দুর্বল রায়দানের মাধ্যমে লুটেরাদের প্রকারান্তরে অনুপ্রাণিত করে, আমজনতার দুর্ভোগ বাড়তে বাধ্য। বিশ্বজোড়া ধান্দার ধনতন্ত্রে লুটের আবহ আছেই। এদেশে এখন রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে লুটেরা বাহিনী আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। লুটেরা পুঁজির সাঁড়াশি আক্রমণে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। হিন্দুত্ববাদীদের সাথে কর্পোরেট পুঁজির গাঁটছড়া এই লুটের ব্যবস্থা জিইয়ে রাখতে চায়। ন্যায়বিচার পেতে তাই সরকার বদল জরুরি। তাই,এই লুটেরাজোটের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।

Comments :0

Login to leave a comment