STORY — DEBASHIS BHATTACHARJEE / MUKTADHARA

গল্প — পোস্টমর্টেম / মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

STORY  DEBASHIS BHATTACHARJEE  MUKTADHARA

গল্প

পোস্টমর্টেম

দেবাশিস ভট্টাচার্য 

    হাড় হিম করা মোটরবাইকের তীব্র শব্দ ছুঁড়ে দিয়ে গেল ত্রাস। কাঠফাটা গ্রীষ্মের নিচে  পড়ে থাকা একটা গ্রামকে চিরে দুফালা করে চলে গেল। নিবারণের দাওয়ায় অনেক ভিড়। ন্যায়ের পক্ষে জড়ো হয়েছিল। শেষ রক্ষা হলো না তবু। নিবারণকে ওরা তুলে নিয়ে গেল গায়ের জোরে।

    যাবার সময় ছুঁড়ে দিয়ে গেল পাঁচ ছটা বোমা। মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো পরপর আগুন। ধোঁয়ায় ক্ষত হলো বাতাস। ত্রাস ছড়ানো ধোঁয়া। সেই ধোঁয়া ফুড়ে ছুটে গেল ভূতনাথ, সুবল, শাজাহান, দুখিরাম, দিবাকর ওদের পিছন পিছন।

    এমনিতেই ভাঙা কুঁড়ে। সেটাকেও ভেঙেছে ওরা। তবু দাঁড়িয়ে আছে ঘর। ভাঙা তোরণ দাঁড়িয়ে থাকে যেমন। উবড়েছে  বাঁশের খুঁটি। ঝুঁকে গেছে দাওয়ার চাল। হেলে গেছে দরজার পাল্লা। দাওয়ার একদিকে ভাত বসিয়ে উনুনে জ্বাল দিচ্ছিল নিবারণের বউ পদ্ম। যাবার সময় লাথি মেরে উলটে দিয়ে গেছে সেটাকেও। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে অন্নের রক্তছিটে।

     হুমকি ছিল পুড়িয়ে দেবে ঘর। রেপ করবে বউকে। কাজ দেবে না। কেস দেবে পুলিশকে দিয়ে।

     তবে ভয় পাইনি এবার নিবারণ জোর করে গাড়িতে তোলার সময় বলতে শোনা গেছে, জান লিবি তবু উঠাবো লা কাগজ। নিবারণ কেওড়া, এবার প্রার্থী হয়েছে ভোটের। খরো আকাশের নিচে পড়ে আছে তার কণ্ঠরুদ্ধ কুঁড়ে। বাংলার ঘোর কালবেলা।

                                    *   *   *   *  *  *      

     ভূতনাথকে হাসপাতালে পাঠানোর বিনিময়ে ফিরিয়ে আনা গেছে নিবারণকে। শাজাহান বলল, ‘এ ঘর আর লিরাপদ লয়গো নেবারণদা।’

     নিবারণ দরজার পাল্লাটাকে সোজা করার চেষ্টা করছিল। পদ্মকে বলল, ‘পুঁটলি কর, ক-টা জামাকাপড় গুচায়ে লে।’

     --- কেনে!

     ---যেতি হবে।

     ----কোতাকে!

     ---ব্যবস্তা হোচে।

     ---ভূতনাথদার কি হচে!

     ---রড মারিচে মাতায়!

     কাকি বলল, ‘শালো গুখেগোর বেটা! সুখ কাড়িচে, শান্তি কাড়িচে। ভোট কাটতি দিব না ইবার! তুই যা। মোরা আচি হেতা।’

     প্রচন্ড রোদ।  জল, জমি, ফসল, মাটির লড়াই। তীব্র দহন মাথায় নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ক-জন মানুষ। শীর্ন সন্ন্যাসীর মত লাগছে নিবারণকে। পুঁটলি কাঁখে পদ্মকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন এক অহংকারী ভিখারিনী।

                                           * *  *  *

     একটা বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে দুর্বৃত্তরা। দূরবর্তী কোনো একটা গ্রামের বাড়ি জ্বলছে দাউদাউ করে। শেল্টারে বসে সেই আগুন টিভিতে দেখছিল নিবারণ। আর ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠছিল সে। তার কুঁড়েটাও একা পড়ে আছে গ্রামের প্রান্তে। খুব সামান্য দিয়ে গড়া তার একান্ত গেরস্থ।

     সোমাদি বলল, ‘একটা সন্ত্রাসকে কেমন মিডিয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে দেখুন! কই আমাদের একটা প্রতিরোধকে দেখাচ্ছে ওরা? আমাদের প্রতিরোধের ভয়ে পোষা গুণ্ডাগুলো পিছু হঠছে দেখাচ্ছে টিভিতে!      

        এই শেল্টারে এসে সোমাদিকে দেখেছে নিবারণ। দেখে আরো জোর বেড়েছে মনের। জেলা থেকে সোমাদিকে পাঠিয়েছে কাগজপত্র রেডি করে দেবে বলে। প্রথম দিনে অফিসে ঢুকে এলোপাথাড়ি ভাঙচুর করে গেছে ওরা। তাতে মাথা ফেটেছিল সোমাদির। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা।

     নিবারণ দেখলো ঘরটা যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে টিভিতে, আলোচনা করতে করতে দাঁত ক্যালাচ্ছিল বাবুরা। ওই লোকগুলো দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু টিভিতে বসে বসে দাঁত ক্যালায়, আর পক্ষপাত জটিল থেকে জটিলতর করে গুলিয়ে দেয় মানুষকে। ওই যে আগুনের শিখা দ্যাল পুড়িয়ে চাল পুড়িয়ে নুয়ে পড়া বাঁশ-কঞ্চিতে গিয়ে ঠেকছে, তখনো গর্জে উঠেছে কেউ! শালা বরাবর খেসারত দিয়ে আসছে গেরামের কুঁড়েঘর।

     সোমাদি বলল, ‘জেনে রাখবেন মিডিয়ার এখন আর কোনো উপকারিতা নেই। উলটে বলছে এই বাড়িটায় নাকি বাইরে থেকে অগ্নিসংযোগ করা হয়নি! স্টোভ বাস্ট করে আগুন ছড়িয়েছে ঘরে। হাস্যকর! বলির খুনকে বলছে লাল রং! বিশ্বাস করবে মানুষ!’

      ঘরটাকে এইভাবে জ্বলতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল নিবারণের। বাংলায় সন্ধ্যার তলায় পড়ে থাকা কুঁড়েঘরগুলোকে যে একই রকম দেখায়। দাওয়া থাকে সামনে। সেগুলো ঝকঝক করে গোবোর আর ন্যাতায়। সেইসব কাঁচা বাড়ির আনাচে কানাচে লুটিয়ে পড়ে চাঁদ। উঠোনের একটা দুটো গাছ খটখটে রোদকে মাটিতে নামিয়ে আনে টুকরো টুকরো করে। নিবারণ দেখলো এখন সেখানে উঠনের থৈ থৈ জলে ভাসছে সংসারহারা ঘটিবাটি।

       সন্ধেবেলা খবর এলো ভূতনাথ আর নেই! ইস্পাতের চোয়াল আর সড়কি হাতে ধানক্ষেতে রুখে দাঁড়ানো ভূতনাথ নেই আর! ফাটল মাটির ওপর পড়া ভূতনাথের ছায়াটা স্তব্ধ হয়ে গেল চিরকালের মতো। স্তব্ধ হয়ে গেল রুখে দাঁড়ানো ভুতনাথের ভাস্কর্য।

       ভারি হয়ে উঠল চারপাশের বাতাস। মৃত ভূতনাথের জন্য টিভিতে একলাইন একটা বাক্য ছুঁয়ে গেল শুধু। সোমাদি বলল, ‘শহীদের রক্তে মাটি আরো উর্বর হয় জানবেন।’

       ভূতনাথ এখন শুয়ে আছে সূর্যের পদতলে। ভূতনাথের পদতলে হাজার হাজার মানুষ।  এক মৃত ক্ষেতমজুর। মারা যাবার পরও যেন জীবিত সে! একটা কঠিন যুগ পার হয়ে সে যেন শুয়ে আছে মাটিতে। শুয়ে আছে রক্তমাখা এক ভগবান।

        যে ম্যাটাডোরটা করে আনা হয়েছে ভূতনাথকে, তার ওপর উঠে দাঁড়ালো সোমাদি। দীপ্ত কণ্ঠে বললো, ‘আজ একজন গ্রাম-প্রহরীকে হারালাম আমরা। একহাঁটু চাঁদ মাড়িয়ে মাড়িয়ে ভূতনাথদা পাহারা দিত গ্রাম। কিন্তু আপনারা দেখেছেন ভূতনাথদার শরীর ময়না তদন্তের নামে দীর্ঘক্ষন আটকে রাখা হলো অকারণে। ঘন্টার পর ঘন্টা। কেন জানেন! মুড়ি-মুড়কির মতো পড়া বোমা টপকে টপকে ও প্রার্থীদের মনোনয়ন করিয়েছে। এলোপাথাড়ি বন্দুকের গুলি মোকাবিলা করে ও ফিরেছে গ্রামে। জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া নিবারণ দাদের মত মানুষদের বুক চিতিয়ে ফিরিয়ে এনেছে চোখে চোখ রেখে। কোন সাহসে একজন সামান্য ক্ষেতমজুর এতসব করতে পারে, সেই সবকিছুর পোস্টমটেম আজ করছিল ওরা! পোস্টমটমের পর ওরা তাই হতভম্ব! ওদের চিন্তার জট পাকিয়ে গেছে বন্ধুগণ। তাই একটা চালচুলোহীন মৃত লাশকে আমাদের হাতে তুলে দিতে ঘন্টার পর ঘন্টা ভাবতে হয়েছে ওদের!

       প্রবল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়লো প্রান্তর। একটা ধবধবে সাদা চাদরের নিচে ঘুমিয়ে আছে ছেঁড়া গেঞ্জি পরা এক চাষী। ভূতনাথ মন্ডল।

 

 


 

Comments :0

Login to leave a comment