গল্প — মুক্তধারা
লকডাউন
সাঁঝবাতি পাল / নতুন বন্ধু
খানিকটা জপ করতে করতেই ইস্কুলে ঢুকলাম আমি।"ঠাকুর আজ যেন পটল আসে,প্লিস,প্লিস ঠাকুর"
দরজায় দাঁড়িয়ে খুব দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে পটলের ব্যাগটা খুঁজলাম।নাহ্ নেই।স্কুল খুলেছে প্রায় দু সপ্তাহ হল।কোনো খোঁজ নেই ছেলেটার।ওর মায়ের একটা মোবাইল ছিল।কতবার ফোন করেছি ,কোনো সাড়া শব্দ নেই।ওর বাড়ি যাবো? কিন্তু কখন...বাবাকে কি বলব।আমার বাবা এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক।তাই আমি যতই ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র হইনা কেন।রোজ বাবার সাথেই স্কুলে যাতায়াত করি।এসব ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত ভাবে একটা সুযোগ এসে গেল আমার কাছে।টিফিনের পরেই বাবা ডেকে বললো "তোদের ক্লাসের বিকাশের জ্বর।সাবধানে ওর সাইকেলটা নিয়ে একটু বাড়ি ছেড়ে আয় তো।" আর আমাকে পায় কে! যদ্দূর জানি পটলাদের বাড়ি বিকাশের বাড়ির দিকেই।ওকে নিয়ে ভীষণ জোরে ছোটালাম সাইকেলটা।ওকে বাড়িতে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম "পটলাদের বাড়িটা কোনদিকে বলতো?" ও একটু থেমে বললো.."ওই তো সামনের দুটো বাড়ি পরেই,দেখবে টিনের চাল,সামনে একটা জাম গাছ আছে। কিন্তু ওরা তো থাকেনা গো.."
"থাকেনা? কেন?" বিকাশ বললো,"ঠিক জানিনা,ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই আর দেখিনি"
আমি যেন কেমন আকাশ থেকে পড়লাম,ওর বাবা মারা গেছে?! কই কেউ বলেনি তো। ওদের বাড়িটা যেন কোনোভাবে দাঁড়িয়ে,কাঠের দরজায় নামমাত্র একটা তালা ঝুলছে।মাধ্যমিকের রেজাল্ট জানতে ওকে শেষবার ফোন করেছিলাম।বলছিলো পরীক্ষাটা হলে ভালো হতো রেজাল্টটা।
আমি স্কুলে ফিরে এলাম।মনটা খারাপ হয়ে গেল।পটল,রোগা ছিপছিপে চেহারা।ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব ক্লাস সেভেন থেকে।বাবার কড়া নিরাপত্তা থেকে লুকিয়ে যেটুকু আনন্দ করেছি তার সবসময়ের সঙ্গী ছিল পটল।স্কুলের বাইরের দোকানে কারেন্ট নুন পাওয়া যেত...জিভে দিলেই কেমন যেন শক্ লাগে।পটল-ই প্রথম তার খোঁজ দেয় আমাকে।তারপর স্কুলের পেছনের পুকুরে যে ভুত বেরোয় সেটা দেখতেও তো বিকেল বেলা ও আর আমি এসেছিলাম একদিন।সংস্কৃত পরীক্ষায় শ্যামলকে বাগিয়েছিলো ও,কারণ টুকলি করার সাহস একমাত্র শ্যামলের ছিল।তার বদলে ও আবার চপ খেয়েছিল আমার টিফিনের টাকায়।
ধুর! বুঝতে পারছিনা কি করা উচিৎ।কাউকে কিছু না জানিয়েই একটা পরিবার বেপাত্তা হয়ে গেল? বাবাকে বলবো?না থাক।পটলদের টানাটানির সংসার।তার মধ্যেও মোটামুটি ভালোই পড়াশোনা করত ও।বাবা বাইরের কারখানার কাজ করত।লকডাউন হওয়ার পর ফিরেও এসেছিলেন।তারপর কি হলো? মারা গেলেন কিভাবে?!
এরকম অজস্র প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে ঘুরতে যেন নিজেরাই হারিয়ে গেল।স্কুল,টিউশন,ইলেভেনের মোটা মোটা বই,পরীক্ষার চাপের মাঝে যতবারই পটলের কথা মাথায় এসেছে,আমি যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গিয়েছি।দেখতে দেখতে প্রায় অনেকগুলো মাস কাটিয়ে ফাইনাল পরীক্ষার দোরগোড়ায়।রাতটুকু কাটলেই সকালবেলা পরীক্ষা।দিনগুলো কেমন যেন দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে।এইতো সেদিন ক্লাস টেন এ উঠলাম।তারপরই করোনা।লকডাউন।শহরের দিকে শুনেছিলাম ফোনেই ক্লাস হচ্ছিল।এখানে কজনের বাড়িতেই আর ফোন।ওভাবেই কেটে গেল মাসের পর মাস।রেজাল্ট বেরোলো পরীক্ষা ছাড়াই।স্কুল খুললো আস্তে আস্তে।আজ বহুদিন পর আবার পটলের কথা মনে পড়ছে।এখন কেমন যেন আবছা হয়ে আসে ওর মুখটা।বুঝতে পারিনা আদৌ এই নামে সত্যি কেউ ছিল কি না।এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম মনে নেই।
সকালে ঘুম ভাঙলো টিভির আওয়াজে।বাবা খবরের চ্যানেলের সামনে গম্ভীর হয়ে বসে।এক কাগজের কারখানায় আগুন লেগেছে কাল রাতে।দমকল আসতে নাকি অনেক দেরি করেছে।পাশাপাশি বসতিগুলো পুড়ে গিয়েছে রাতারাতি।বাবা জিজ্ঞেস করল "হ্যাঁ রে,পটল মাহাতো-কে চিনিস তুই?"কেমন যেন চমকে উঠলাম নামটা শুনে।থতমত খেয়ে বললাম,"হ্যাঁ আমার সাথেই তো পড়ত।" বাবা শুধু মাথা নাড়লো।আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।বুকের ভেতরে কেমন যেন শব্দ হচ্ছে।
স্কুলে পৌঁছে দেখি একটা থমথমে পরিবেশ।লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।একটু পরেই বাবা এলো। পাশে একটা বেঁটে মত লোক।নিস্তব্ধতা ভেঙে বাবা বলা শুরু করলো..."আমরা অনেকেই জানি কাল রাতে কলকাতার এক কাগজের কারখানা থেকে আগুন লেগে অনেক বস্তি পুড়ে গিয়েছে।শুধু তাই নয়,সেই আগুনে পুড়ে আহত ও নিহত হয়েছে প্রচুর মানুষ।অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাই এই দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি এই বিদ্যালয়ের এক ছাত্র পটল মাহাতোকে।"
হঠাৎ যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল আমার চারপাশটা।কানে যেন কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না আমি ।বেশ কিছুক্ষণ থেমে বাবা পাশের লোকটিকে দেখিয়ে বলল,"ইনি রামকৃষ্ণ মাহাত।পটলের দুঃসম্পর্কের মামা।ওখান থেকে আজ ভোরে এনাকেই ফোন করে জানানো হয় ঘটনাটি।লকডাউনের পর কোভিডে পটলের বাবা মারা যান।সংসার চালাতে পটল ও তার মা কলকাতায় যায় কাজের খোঁজে।ওই কারখানাতেই কাজ করত পটল,পাশাপাশি বস্তিই ছিল মাথা গোঁজার জায়গা।কালকের বিধ্বংসী আগুনে প্রাণ চলে গেল এক ঘুমন্ত নিষ্পাপ শিশুর।তার মা গুরুতর আহত।ওনাকে ভর্তি করা হয়েছে স্থানীয় হাসপাতালে।আমরা বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও ছাত্ররা মিলে সাধ্যমত আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করব ।সেই টাকা রামকৃষ্ণ বাবুর হাত দিয়ে ওনার কাছে পৌঁছে যাবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব উনি যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন।আজকের বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল করা হল।বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রকে পটলের আত্মার শান্তি কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।"
গলার কাছে কেমন যেন ব্যথা করছে।আমি ঠিক ভেবে উঠতে পারছিনা কিছুই...গলার কাছে দলা পাকানো ব্যথাটা যেন চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অঝোরে।শব্দ আটকাতে আমি হাতটা মুঠো করে মুখের ভেতর চেপে রাখলাম। এরপর একে একে লাইনগুলো ভেঙে ছাত্ররা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো।আমি চুপ করে বসে পড়লাম বাঁধানো বকুল গাছের তলায়। পাশাপাশি কতরকম কথা।কারা যেন ভূগোল স্যারকে জিজ্ঞেস করছে , "কারখানায় আগুন কিভাবে লাগে স্যার?" স্যার বলছেন "ধুর বোকা।ওসব গল্প।বস্তিগুলো ফাঁকা করতে আগুন লাগানো হয়,এমনি এমনি আগুন লাগে নাকি!"
কে জানে হবে হয়তো।ঠিক বুঝতে পারছিনা কিছু।ঠিক কেন আগুন লাগে,কেন বইখাতা ছেড়ে কাজ করতে যেতে হয় পটলকে,কেনই বা লকডাউন হয়।আমার শুধু মনে পড়ছিল কারেন্ট নুন,পানাপুকুর,আর রোগা ছিপছিপে চেহারার পটলকে।যে নামে আজ থেকে সত্যিই আর কেউ নেই!
Comments :0