গল্প
সেবা
------------------------
সৌরীশ মিশ্র
------------------------
নতুনপাতা
গভীর রাত। নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিল টুগ্গা। হঠাৎ কিসের যেন একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ওর। বিছানাতে শুয়েই চোখ মেলে সে। কিন্তু, ঘর অন্ধকার হওয়ায় দেখতে পায় না সে কিছুই। তবে, অন্ধকারে চোখ সয়ে যায় কয়েকক্ষণের মধ্যেই তার। সে শুয়ে-শুয়েই এদিক ওদিক তাকায়। তবে তেমন কিছুই দেখতে পায় না মেঝেতে পড়ে থাকতে সে, যেটা পড়ার জন্য শব্দটা হতে পারে। সে কি তবে ভুল শুনল? না কি অন্য কোনো ঘর থেকে শব্দটা ভেসে এসেছিল? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায় টুগ্গার। কিন্তু, উত্তর পায় না সে এর কোনো প্রশ্নরই। সে তাই ঠিক করে, ফের ঘুমিয়েই পড়বে সে। এই কথা ভেবে যেই না চোখ দু'টো তার বন্ধ করেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার ঠং করে একটা আওয়াজ হোলো পাশের কোনো একটা ঘর থেকে। কি ব্যাপার! আবার আওয়াজ! এইবার ধরফর করে বিছানায় উঠে বসে সে। তারপর তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে আসে সে তার ঘর থেকে। আর ঘর থেকে বেরোতেই টুগ্গার চোখে পড়ে, ওর ঠাকুরদার ঘরে আলো জ্বলছে। কি হোলো! ঠাকুরদার রুমে লাইট জ্বলছে কেন? তবে কি ঠাকুরদার শরীর খারাপ হোলো? প্রশ্নগুলো ভিড় করে আসে স্বাভাবিক ভাবেই টুগ্গার মনে। সে তাই প্রায় ছুটেই চলে আসে ওর ঠাকুরদার ঘরে।
টুগ্গাদের বাড়িতে এই মুহূর্তে ও আর ওর ঠাকুরদা, আদিনাথবাবু ছাড়া আর কেউ নেই। আজ রাত আটটা নাগাদ টুগ্গাদের বাড়িতে ফোনে খবর আসে, টুগ্গার দিদার শরীরটা খারাপ হয়েছে হঠাৎই। তাই তাঁকে দেখতে তাড়াতাড়ি টুগ্গার মামার বাড়িতে চলে গেছেন টুগ্গার বাবা আর মা। পরে অবশ্য টুগ্গার বাবা ফোন করে জানিয়েছেন এই বাড়িতে, ওর দিদা এখন ভালোই আছেন, তবে রাত হয়ে যাওয়ায় ফিরতে পারবেন না ওনারা আজ বাড়িতে। কাল সক্কাল সক্কালই ফিরে আসবেন তাঁরা।
যাই হোক। অতীত থেকে ফের বর্তমানে ফেরা যাক। পনেরো বছরের টুগ্গা তো এক বুক উৎকণ্ঠা নিয়ে দৌড়ে এসে ঢুকল আদিনাথবাবুর ঘরে। আর, ঘরে ঢুকেই দেখল, ওর ঠাকুরদা মেঝের উপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন একটা করছেন। "কি হয়েছে ঠাকুরদা? কি করছো ওর'ম করে?" জিজ্ঞেস করে টুগ্গা।
"দাদুভাই তুমি? ঘুম ভেঙ্গে গেল কি করে তোমার?" ঝুঁকে থাকা অবস্হা থেকে আস্তে আস্তে করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, তারপর নাতির দিকে তাকিয়ে বলেন আদিনাথবাবু।
"কিসের যেন শব্দ হোলো দু'-দু'বার, তাতেই তো ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। তা তুমি কি করছিলে মেঝেতে ঝুঁকে পড়ে?"
"ও কিছু না। পায়ের ব্যাথাটা হঠাৎই বেড়েছে। তাই একটা বাটি মালিশ করার তেলটা ঢালবো বলে এনেছি, হাত থেকে স্লিপ করে মেঝেতে পড়ে গেল বাটিটা। তুললাম মেঝে থেকে সেটা। আবার হাতে তুলেছি যেই, ফের আরেকবার পড়ে গেল হাত থেকে সেটা। এইবার তো খাটের তলাতেই চলে গেল গড়িয়ে। সেইটাই তোলার চেষ্টা করছিলাম ঝুঁকে পড়ে।"
টুগ্গা এবার বুঝতে পারে দু'-দু'বার মেঝেতে বাটি পড়ার শব্দই পেয়েছিল সে একটু আগে।
"তা তুমি আমাকে বলবে তো ঠাকুরদা। আমি শিশি থেকে তেল ঢেলে বাটিতে, তারপর মালিশ করে দিতাম তোমায়।" কথাগুলো বলতে বলতেই মেঝেতে বসে হাত বাড়িয়ে খাটের তলা থেকে বাটিটা বের করে আনে সে। টুগ্গা স্টিলের বাটিটা চিনতে পারে। ঠাকুরদার মাঝেমধ্যেই পায়ে ব্যাথা হয়। তখন এতে একটা তেল ঢেলে মালিশ করে দেয় ওর বাবা।
টুগ্গা এরপর বাটিটা হাতে করে ঐ ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।
"কোথায় যাচ্ছ দাদুভাই?" জিজ্ঞেস করেন আদিনাথবাবু।
"এক্ষুনি আসছি ঠাকুরদা।" ঘরের বাইরে থেকে টুগ্গার গলা ভেসে আসে।
টুগ্গা ঘর থেকে বেড়িয়ে সোজা চলে আসে ডাইনিং রুমে। সেখান থেকে একটা পরিস্কার কাপড় দিয়ে বাটিটা সে ভালো করে মুছে, ফের আদিনাথবাবুর ঘরে ঢোকে। টুগ্গা ভালোই জানে, কোথায় থাকে ওর ঠাকুরদার পায়ে মালিশের তেলটা। সেটা বের করে সে। সেটা থেকে বাটিতে ঢালে কিছুটা তেল। তারপর আদিনাথবাবুর সামনে এসে বলে, "এবার পা-টা তুলে বসো তো ঠাকুরদা। তেলটা মালিশ করে দিই পায়ে তোমার।"
"না না দাদুভাই, তোমাকে মালিশ করতে হবে না। তুমি তেলটা ঢেলে দিয়েছো বাটিটায়, এতেই হবে। আমি মালিশ নিজেই করে নিতে পারবো।"
"তোমাকে যেটা বলছি সেটা করো ঠাকুরদা। না হলে এই রাতে কিন্তু খুব বকা খাবে আমার কাছে তুমি।" একরকম ধমকের সুরেই আদিনাথবাবুকে বলে টুগ্গা। "পা দুটো বিছানায় তুলে লম্বা করে দাও।" একটু থেমে ফের বলে টুগ্গা।
নাতি তাঁর কোনো কথাই শুনবে না যে, তা বুঝতে পারেন আদিনাথবাবু। তাই, বিছানায় উঠে পা দু'টো লম্বা করে দিলেন তিনি। টুগ্গাও একটা চেয়ার টেনে তাতে তেলের বাটিখানা রেখে আদিনাথবাবুর বিছানায় এসে বসে। তারপর বাটিটা থেকে দু'হাতে কিছুটা তেল নিয়ে মালিশ করতে শুরু করে দেয় আদিনাথবাবুর পায়ে।
আদিনাথবাবুও সাথে সাথেই তাঁর দু'হাত বাড়িয়ে দিয়ে টুগ্গার মাথার উপর রাখেন এবং প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করতে থাকেন তিনি তাঁর নাতিকে।
Comments :0