গল্প
স্বপ্নে আমার মনে হল
আশীষ দত্ত
টাইমমেশিন পেয়ে আমি খুব উত্তেজিত ----- হাজার হাজার বছর এগিয়ে বা পিছিয়ে ঘুরে আসতে পারব । পরেরদিনই ড্রাইভার এসে হাজির । চড়ে বসলাম টাইমমেশিনে । বললাম, "আমার স্কুলে পড়ার সোনালী দিনগুলোতে যেতে চাই, ওখানে চলুন ।"
টাইমমেশিনে চেপে গেলাম ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকের দিল্লিতে । গিয়ে শুনলাম, সুলতা বিন তুঘলক দিল্লিতে নেই, সম্ভবত দৌলতাবাদে আছেন । গেলাম দৌলতাবাদে । সেখানে গিয়ে শুনলাম, তিনি না কি কোনো এক ভ্রমণার্থীর উপহার দেওয়া টাইমমেশিনে চেপে ভবিষ্যাৎ দেখতে গিয়ে তাঁর থেকেও বড় মাপের খামখেয়ালিদের সন্ধান পেয়ে প্রচন্ড লজ্জিত হয়ে পড়েন । আত্মহত্যা যেহেতু পাপ, তাই আত্মহনন না করে সেই থেকে তিনি আত্মগোপন করে আছেন ।"
মন আমার খারাপ হল ----- মধ্য যুগের সবচেয়ে দক্ষ, সবচেয়ে শিক্ষিত এবং সবচেয়ে বিতর্কিত সুলতানের সঙ্গে দেখা হল না ।
দেখা হল না ঠিক, তবে টাইমমেশিনে চেপে ঘুরে বেড়ানোর প্রথম শর্ত পূরণ হয়ে গেল । এবার তবে নিশ্চয়ই স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে যাওয়া যাবে । হাতে সময়ও আছে এখনো প্রচুর, কারণ ড্রাইভারের ছুটি হতে এখনো দেরি আছে ।
ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমার স্কুলে পড়ার দিনগুলো তো বড়ই নিরীহ । যাওয়া যাবে তো সেখানে ?" ড্রাইভার ভদ্রলোক তালিকা দেখে বললেন, "হ্যাঁ, যাওয়া যাবে ।"
স্কুলে পৌঁছতেই দেখি, গেটের বাইরে লালচে হয়ে যাওয়া গেঞ্জি, আটহাতি ধুতি পরা খালি পায়ের সেই হজমিওলাটা আজও ওইভাবেই বসে আছে ; রয়েছে সেই নীল রঙা শার্ট-প্যান্ট আর টায়ারের চটি পরা আইসক্রিমওয়ালা ; রয়েছে খেটো ধুতি পরা খালি গা, খালি পায়ের সেই আমসত্ত্বওয়ালা ; গেটের পাশেই বাবলুদার ঘুঁড়ির দোকান । বাবলুদাও সেই একই রকমের ঘুঁড়ি বেচতে ব্যস্ত ; খুব কিনতে ইচ্ছা করছে । এখন আমার কাছে অনেক টাকা । কিনতেই পারি । ফেরবার সময় না হয় কিনে নিয়েই যাব । কিন্তু বাড়িতে সবাই হাসাহাসি করবে না তো !! স্কুলে ঢুকতেই দেখি, সেই রামশরণ দারোয়ানকে । গেট পাহারা দিচ্ছে । আমাকে জিজ্ঞেস করল, "কাকে চাই বাবুজি ?" আমি মৃদু হেসে বললাম, "হামারা স্কুলবেলাকো সাথ মোলাকাত করনে আয়া ।" বৃদ্ধ রামশরণ কী বুঝল জানি না । বলল, "হিড মাস্টারকো কামরা সামনে মে হ্যায় বাবুজি ।" আমি বললাম, "জানি গো রামশরণদা ।" স্কুলের ভেতরে তাকিয়ে দেখি, হুবহু একই আছে ----- একই প্রাঙ্গণে দুটো আলাদা বিল্ডিং-এ গার্লস আর বয়েজ সেকশন । দেখি, হেড মাস্টারের ঘরে এখনো সেই বিনোদবাবু স্যার ! টিচার্স-রুমের গেটে ভুবনবাবু না ? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছি, ভূগোল টিচার ভুবনবাবু স্যারই । এখনো তাঁর হাতে বেত । এই বেত সকলকে ভয় দেখাতে হাতে নিয়ে রাখেন কিন্তু কাউকে মারেন না । ছাত্রদের অসম্ভব ভালোবাসেন । ঘন্টা বেজে উঠল । পিরিয়ড শেষ হল নিশ্চয়ই ! হ্যাঁ, ঠিকই, পিরিয়ড শেষ হল । ছেলেরা বেরিয়ে আসছে ! মেয়েরাও । আচ্ছা, ওটা নিখিল না ? ওটা সুরজিৎ তো ? হ্যাঁ, ঠিকই, সব কটাকেই তো চিনি । ওরা তো আমারই বন্ধু, এক ক্লাসের পড়ুয়া ! বন্ধুরা হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে আসছে ! আচ্ছা, ওটা রূপেনবাবু না ? হ্যাঁ হ্যাঁ, রূপেনবাবুই । নইলে সবাই ঘিরে ধরবে কেন । ঠিক ধরেছি, ওই তো কাঁধের ব্যাগ থেকে বিস্কুট আর সন্দেশ বের করে সকলকে দিচ্ছেন । মনে হল, ওদের মাঝে গিয়ে দাঁড়াই । বিস্কুট আর সন্দেশ নিই । বুঝতে পারছি, ওদের মাঝে আমাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারবে না । কিন্তু মনে হচ্ছে, সবকথা খুলে বললে, নিশ্চয় চিনতে পারবে । তখন না হয় ওদের সঙ্গে একটু রবারের বল খেলে নেওয়া যাবে ।
হঠাৎ নজরে পড়ল মেয়েদের বিল্ডিং-এর দোতলার ছোট বারান্দার দিকে । দেখি, বারান্দার ওপর ঝুঁকে পড়া পেয়ারা গাছটা আজও ঝুঁকেই আছে বারান্দার ওপর । ডালপালার ফাঁকে ওদুটো কার চোখ ? অমন মায়াময় চোখ নিয়ে কে দেখছে ? মালবিকা না ? চশমাটা পরিস্কার করে দেখি, হ্যাঁ, মালবিকাই । কী দেখছে মালবিকা ? ও কি এখনো আমার জন্য আচার নিয়ে অপেক্ষা করছে ?!! আমাদের বাড়ির পাশের বস্তির মেয়ে মালবিকা । মেলামেশার তেমন সুযোগ ছিল না । তবুও কেন জানি না, ও রোজ আচার নিয়ে আসত আমার জন্য । ওদের ঘরে আচার ছাড়া কিছু থাকত না যে, তাই আচার দিয়েই আনন্দ পেত মালবিকা রোজ । আচ্ছা, ওর মরমে কি এখনো আমার জন্য পথ চেয়ে থাকা আছে ? গিয়ে দাঁড়াব সামনে ? চিনতে পারবে ওর সেই ভালোলাগার কিশোর পড়শীকে আজকের এই এতবড় মানুষটার মাঝে ? বাড়িয়ে দেব হাত, যদি ধরে ?
"বাবু, ওঠ ওঠ, উঠে পড়, সন্ধ্যা হয়ে গেল যে।" মায়ের ডাকে আমার অদ্ভুতুড়ে ঘুরে বেড়ানো, ঘুঁড়ি ওঁড়ানো, হজমিগুলি খাওয়ার, মালবিকার এনে দেওয়া আচার খাওয়ার সেই স্কুলে পড়ার সোনালী দিনগুলো যেন চকিতে হারিয়ে গেল ।
Comments :0