Story / MUKTADHARA — DEBASHIS BHATTACHARJEE / MAP — 22 JANUARY 2024

গল্প / মুক্তধারা — মানচিত্র / দেবাশিস ভট্টাচার্য — ২২ জানুয়ারি ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

Story  MUKTADHARA  DEBASHIS BHATTACHARJEE  MAP  22 JANUARY 2024

গল্প  

মুক্তধারা

মানচিত্র

দেবাশিস ভট্টাচার্য

     ছবিটা দেয়ালে টাঙানো। সন্ধ্যাকে ফুটো করে হেঁটে যাচ্ছে একটা প্রদীপ। একদল মানুষ ফিরছে কাজ থেকে। ওরা কাজে গিয়েছিলো যেন সেই লৌহযুগে। ওদের ফিরে আসার ছায়াগুলোকে দেখাচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসের মতো।

     সেই টঙানো ছবিটার ওপর সারা মাসের তারিখ লেখা। ঘরের ভেতর শকুনের চোখের সাদা অংশের মতো ঘোলাটে আলোগুলো জ্বলছে সিলিং-এর ভেতর থেকে। এ আলোর  কোনো রশ্মি নেই।

     ঘরটা সজ্জিত। ছিমছাম। একটা কোণে বালির টব থেকে উঠে, তারপর ঝুঁকে আছে একটা নিঃসঙ্গতা রঙের ডাল। আবছা ছায়াটাকে মনে হচ্ছে বয়স্ক। যেন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে আছে মাটিতে পড়া একটি দাগ।

     ঘরের মাঝখানে টেবিলে দু কাপ কফি রেখে আলোচনা করছে দু-জন। দু-জনের মুখেই মুখোশ। টেবিলের মাঝখানে রাখা মৃত্যুপথযাত্রী একগুচ্ছ গোলাপ।

     একটা লোক বললো, ‘সময় তো হয়ে এলো?’ অন্য জন বললো, ‘হ্যাঁ’।

      প্রথম জন কফিতে চুমুক দিয়ে বললো, ‘গতবার তো মাত্র চল্লিশটা কফিনেই কাজ হাসিল হয়েছিল! এবার কি করবে ভেবেছো কিছু?’ মানে কোনো রাস্তা টাস্তা?

    - আরে রাস্তা তো একটাই। মদ সেই পুরনো, শুধু একটা নতুন বোতল জোগাড় করা।

    - হুঁ, এ ব্যাপারে কিছু ভাবলে?

     শুরু হলো আলোচনা। আকাশে জমলো মেঘ। বৃষ্টি হলো। বৃষ্টির জল সাপের মতো একে বেঁকে চলে গেল সাগরে। ফসল হলো না আশানুরূপ। আলোচনা চলছে। রাস্তার ধুলো বুঝে নিল রাজনৈতিক লাশ। রাস্তা আরো দেখলো শিক্ষিত  
ছেলেমেয়েদের চোখের জলের শিশির,  শুকিয়ে গেল টেবিলে রাখা গোলাপ ফুলগুলোর যৌনাঙ্গ, নদী শুকিয়ে গেল ঘুমের ভিতরে। আলোচনা  চলতে লাগলো তখনো।

    তারপর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অন্ধকার থেকে কফির পেয়ালার তলানিতে জন্মালো কিছু পোকা। দুটো পেয়ালায় দু’রকম। একজন বলে উঠল, ‘সর্বনাশ, এতো পোকা এলো কোত্থেকে!’

      - কি জানি, আচ্ছা আমরা কি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?

       - তাইতো মনে হচ্ছে। মেঘগুলো দেখছো না! ওদের শরীরে কেমন শরৎকালের পাগলামি!

     - হু, ঠিক বলেছো। কিন্তু এই পোকা গুলোকে নিয়ে তো মহা ঝঞ্ঝাট! দেখোতো কোথাও একটা পাথরের টুকরো ফুকরো ...

     অন্য লোকটা এবার উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে। খুব ভালো করে দেখলো পোকাগুলোকে। বললো, ‘চিনতে পারছো এদের!’

     - মানে! কি বলতে চাইছো তুমি!

    - এদের আদি নিবাস একশ্রেণির মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে। এরা খুব সাংঘাতিক প্রকৃতির! এরা মানুষের চিন্তাকে দীর্ঘায়িত করে।

    - কিন্তু এরা এখানে এলো কি করে!

    - বেয়ে বেয়ে। ওই যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমরা।

    - এদের এক্ষুনি ধ্বংস করো!

    - দাঁড়াও, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে!

    - বুদ্ধি!

    - হ্যাঁ, ও সব পাথরের টুকরো ফুকরোর আর দরকার নেই।

    - তবে!

       লোকটার চোখ আর টেবিলের পেয়ালায় জন্মানো পোকাগুলোর মধ্যে তৈরি হলো একটা সরলরেখা। সে বললো, ‘নতুন বোতল পেয়ে গেছি দোস্ত!’

      - কই আমি তো কোনো বোতল দেখতে পাচ্ছি না!

       লোকটা এবার একটা পেয়ালা থেকে গোটা কতক পোকাকে আঙুল দিয়ে অল্প টিপে ছুঁড়ে ফেলে দিলো পেয়ালাটায়। সঙ্গীকে বলল, ‘এবার দেখতে পেয়েছো বোতল?’

       সঙ্গীটার চোখ চকচক করে উঠলো এবার। বললো, ‘কি অসম্ভব তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তোমার! চলো এবার আমরা পালিয়ে যাই।’

      - হ্যাঁ চলো। এই সময়টাতে বাকি কাজগুলো সেরে নিই আমরা। আমি উত্তরে যাচ্ছি, তুমি যাও দক্ষিণে। মাসখানেক পর এখানেই দেখা হবে আবার।

                                      (২)  

      হুড়োহুড়ি পড়ে গেল দুটো পেয়ালার পোকাগুলোর মধ্যে। পোকাদের শরীর থেকে বেরিয়ে, নির্জন রক্ত গড়িয়ে পড়ছে টেবিলের গা থেকে। মাটি তাকে ধারণ করছে কেঁপে কেঁপে। আর এই সব দেখছিলো ঘরের কোণের টবে বালির  
ওপর রাখা সেই ডালের ছায়াটা। ততোদিনে আরো বৃদ্ধ হয়েছে সে।

      ছায়াটা অতি কষ্টে টেবিলের কাছে এসে একটা দুঃখী চাঁদ জ্বাললো আকাশে। পোকাগুলোকে বললো, ‘এদিকে এসো, কথা আছে তোমাদের সঙ্গে।’

       একটা পোকা বললো, ‘তুমি কে?’

     - দেখতে পাচ্ছ না, আমি একটা বৃদ্ধ ছায়া। আমার পিতামহর ছায়া পড়ে আছে সিন্ধু সভ্যতার পলি মাটিতে। আর একটা পেয়ালার পোকা তেড়ে এসে বললো, ‘কি চাও তুমি?’

      - রক্তপাত মুছতে। এই আগুনটা নেভাতে চাই। জেনে রাখো, শুধু শুভ কাজে ব্যবহার করতে হয় আগুন।

      - ওরা আগে আগুন ছুড়েছে আমাদের দিকে! পেয়ালার ভেতর থেকে চিৎকার করে  বললো একজন।

      অন্য পেয়ালার এক তরুণ পোকা বললো, ‘ওরা নোংরা, আদাড়ে। শকুনের মাংস খায়’।

      ছায়াটা বেশ রেগে গেল এবার। বললো, ‘থামো। অনেক হয়েছে। কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছ তোমরা?’

     পোকাগুলো তাদের কান খাড়া করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলো। একটি বৃদ্ধ পোকা বললো, ‘হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। একটা বাতাসের শব্দ।’

      ছায়াটা বললো, ‘সাপের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনেছো কোনোদিন?’

       বৃদ্ধ পোকাটা বলল, ‘হ্যাঁ, অনেকটা সেই রকম!’

      ছায়াটা বললো, ‘দু- দুটো মানুষের নিঃশ্বাস এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে!’

      একটা রক্তাক্ত পোকা বললো, ‘মানুষের নিঃস্বাস!’

     - হ্যাঁ, আর সেটা বলতেই তো কাছে ডাকছি তোমাদের দু-জনকে।

      দু-টো দল থেকেই প্রবীণ কিছু পোকা এগিয়ে গেলো ছায়াটার দিকে। সেই ছানি পড়া আলোয় ছায়াটা বলতে লাগলো দুটো মানুষের বর্বর বৃত্তান্ত।

      সব শুনে দু-দলের প্রবীণ পোকারা আলোচনায় বসলো। তারপর তাদের একজন ছায়াটাকে বললো, ‘তুমি তো পারো বিষাক্ত বাতাসটা শুষে নিতে?’

      হ্যাঁ, অনেকক্ষণ ধরেই চেষ্টা করছি আমি। দেখছো না আমি কতটা বৃদ্ধ।

      ঠিক এক মাস পর ওই লোক দুটো এলো আবার। হাসতে হাসতে খুললো গবেষণাগারের দরজাটা। ঘরের মধ্যে ঢুকে নির্বাক হয়ে গেলো ওরা। টেবিলে পড়ে রয়েছে একটা মানচিত্র। পোকাগুলোই তাদের শরীর দিয়ে এঁকেছে সেই  
ছবিটা। একটা ভারতবর্ষ পড়ে আছে সারা টেবিল জুড়ে।

Comments :0

Login to leave a comment