Editorial

হিন্দুত্বের অভিন্ন প্রকল্প

সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial


নরেন্দ্র মোদী বুঝে গেছেন তাঁর সেই বহুল প্রচারিত স্লোগান সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কোনও কাজে আসবে না। ঐ স্লোগান যে নিছকই মানুষের চোখে ধুলো দেবার কারসাজি ছিল সেটা ধরে ফেলতে মানুষের বেশি সময় লাগেনি। তাই মোদী বাহিনী এখন ঐ স্লোগান সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলেন। মোদী সরকার কখনোই সকল মানুষের পাশে ছিল না। সকল দেশবাসীর সার্বিক উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন এ‍ই সরকারের নেই তেমনি সেই লক্ষ্যে সরকারি কোনও নীতি ও কর্মসূচি গৃহীত হয়নি। আপাত দৃষ্টিতে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অর্থাৎ জিডিপি বৃদ্ধির হার হালে খানিকটা বেশি হওয়া এবং শেয়ার বাজারে অত্যুৎসাহী জুয়াড়িদের ফাটকাবাজির ফসল হিসাবে শেয়ার সূচক অবিশ্বাস্য উচ্চতা ছুঁলেও সেটা ১৪৩ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে ১০ শতাংশকেও স্পর্শ করছে না। তাতে কর্পোরেট মুনাফা এবং কর্পোরেট মালিকদের সম্পদ হু হু করে বাড়লেও আমজনতার কাছে তার ছিটেফোঁটাও আসে না। আরএসএস-বিজে‍‌পি ভাষ্য অনুযায়ী দেশের অর্থনীতি মোদীর হাতের ছোঁয়ায় তরতর করে বাড়লেও কর্মসংস্থান তৈরি হয় না। মানুষের আয় বাড়ে না।


অথচ সাধারণের ব্যবহারের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যে ক্রমাগত উচ্চহারে দাম বেড়ে চলেছে। পেট্রোপণ্যের দাম বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে সরকার নিজেই মূল্যবৃদ্ধির উর্বর জমি তৈরি করে রেখেছে। মূল্যবৃদ্ধি বিত্তবানদের জীবনযাত্রায় কোনও প্রভাব ফেলে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। কারণ জীবনযাত্রার বর্ধিত ব্যয় সামাল দেবার মতো আয় তাদের বাড়ে না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের শ্রমজীবীদের প্রকৃত আয় কমেছে। সুদের হার কমিয়ে বিপুল সংখ্যক বয়স্ক ও অবসরপ্রাপ্ত মানুষের জীবন সঙ্কট জর্জরিত করা হয়েছে। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নের পিটুলি গিলিয়ে জনগণ‍‌কে বেহুঁশ করা যাবে না। অতএব ভোট বৈতরণী পার হতে গেলে হাতে থেকে যাচ্ছে সেই সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিভাজনের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক অস্ত্রটি। আগামী লোকসভা নির্বাচনে মোদীদের কাছে সেটাই হতে চলেছে প্রধান ভরসা। আর সেই ভরসা হিসাবে মোদীরা আঁকড়ে ধরতে চাইছেন অভিন্ন দেওয়ানিবিধিকে।
আরএসএস’র নির্দেশে আঁটঘাট বেঁধে পরিকল্পনা করে তাই মাঠে নেমেছে শাসক শিবির। একজন অতি পছন্দের ব্যক্তিকে খুঁজে এ‍‌নে ২০২০ সালে গঠন করা হয়েছে ২২তম আইন কমিশন। এবং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও তাকে রেখে দেওয়া হয়েছে দেড় বছর মেয়াদ বাড়িয়ে। আসলে ২০১৬ সালে গঠিত আইন কমিশননের প্রধানকে নিয়ে বেকায়দায় পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান ২২তম কমিশনের বিশ্বস্ত প্রধানকে হাতছাড়া করতে চায়নি সরকার। আগের প্রধান অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে রিপোর্টে বলেছিলেন এই পর্যায়ে এই বিধি প্রণয়ন জরুরিও নয়, কাঙ্ক্ষিতও নয়। মোদী সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল সেই রিপোর্ট। তাই ভোটের আগে নতুন প্রধান নিয়োগের ঝুঁকি নেয়নি, সরকার। মেয়াদ বাড়িয়ে বিশ্বস্ত প্রধানকেই রেখে দেয় তাঁকে দিয়ে প্রত্যাশা মতো কাজ হাসিল করতে।


ভোটের আগে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্কের ঝড় তুলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বিভাজন তীব্র করে মেরুকণের ফায়দা লুটতে চায় বিজেপি। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আইন কমিশন গত ১৪ জুন দেওয়ানি বিধি নিয়ে ধর্মসংস্থা ও ব্যক্তিদের মতামত আহ্বান করে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নিজে এ‍‌ই বিধির পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। শাসক নেতারা বলতে শুরু করেন সংসদের এই অধিবেশনেই এ‍‌টি পাশ করানো হবে। প্রচারের বহর দেখে স্পষ্ট হয়ে যায় আসল লক্ষ্য ভোটের আগে বিতর্ক খুঁচিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন।
মনে রাখা দরকার ভিন্নতা ও বৈচিত্রই ভারতীয় সমাজের ঐক্য ও সংহতির ভিত্তি। বহুত্বের মধ্যে মিলনই ভারতে গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই সংবিধান নির্দেশিত সমতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। উপর থেকে জোর করে অভিন্নতা ছাপিয়ে দিয়ে সমতা আনা যায় না। তাতে হিত বিপরীত হওয়াই অনিবার্য পরিণতি। আরএসএস’র লক্ষ্য সমতা নয়। তারা অভিন্নতার দোহাই দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন চায়। হিন্দুত্ববাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসাবেই অভিন্নতাকে বলপূর্বক চা‍পিয়ে দিতে চায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের ছাঁচে ফেলে অন্য সব ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এটা হিন্দুত্ববাদের এক অভিন্ন প্রকল্প।

Comments :0

Login to leave a comment