NAUSHAD SIDDIQUE JAILED

কেন নৌশাদ সিদ্দিকি জেলে

রাজ্য জেলা

NAUSHAD SIDDIQUE JAILED

প্রতীম দে

ভাঙড়ের বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকির জেল হেফাজত হয়েছিল ১ ফেব্রুয়ারি। ২১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁকে। শুক্রবার ফের তাঁকে পুলিশ হেপাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিল বারুইপুর আদালত। 

তৃণমূল সরকার এবং তার পুলিশই সিদ্দিকিকে জেরার জন্য পুলিশ হেপাজতে পাঠানোর আবেদন জানিয়েছে আদালতে। আদালতে পুলিশের অভিযোগ, বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি’র সঙ্গে সিদ্দিকির টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গিয়েছে। নির্বাচনের দেড় বছর বাদে পুলিশ জেনেছে এই তথ্য, যখন সারা রাজ্য বিরোধী বিধায়কের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে সরব। 

মূল প্রশ্নকেই ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে পারবে না?

এই প্রশ্ন বাড়ছে, কেন নৌশাদ সিদ্দিকিকে জেলে রাখতে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। 

‘‘তোমার চুপ করো তোমরা শূন্য।’’ 

আটটার টেলিভশন ‘শো’-তে তৃণমূলের বক্তারা সিপিআই(এম)’র বক্তাদের এমনই বলে থাকেন। তার সঙ্গে বলেন, ‘‘ওই তো একটা আসন রয়েছে তাও সেটা আইএসএফের।’’

আইএসএফ। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলটি তৈরি হয়। নির্বাচনী প্রচারে নির্বাচন কমিশনও এই দলকে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য প্রচারের দায়ে অভিযুক্ত করতে পারেনি। 

বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙড় থেকে আইএসএফের প্রতীকে লড়াই করেছিলেন নৌশাদ সিদ্দিকি। একমাত্র বিরোধী বিধায়ক হয়ে বিধানসভায় যান। ব্যস সেখান থেকেই তাঁর ওপর যত রাগ তৃণমূলের ‘তাজা নেতা’ আরাবুল ইসলামের। 

নৌশাদ সিদ্দিকিকেই কেন একমাত্র বিরোধী বিধায়ক বলা হচ্ছে ব্যাখ্যা করা দরকার। ৭৭ জন বিধায়ক ছিল বিজেপি’র। সেখান থেকে মুকুল রায় সহ বেশ কয়েকজন নির্বাচনের ফলাফলের পরেই তৃণমূলে যোগদান করেন। কিন্তু নৌশাদ একা লড়াই চালিয়ে জাচ্ছেন বিধানসভায়। মূল্যবৃদ্ধি থেকে আনিস খান, বগটুই। সব বিষয় সরব হয়েছেন নৌশাদ সিদ্দিকি। তাই কি ওর ওপর এতো রাগ?

কি হয়েছিল ২১ জানুয়ারি ?

২১ জানুয়ারি আইএসএফ’র প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে ধর্মতলায় সভার আয়োজন করা হয় আইএসএফের পক্ষ থেকে। প্রধান বক্তা নৌশাদ সিদ্দিকি। ওই দিন ভাঙড়ের হাতিশালা মোড়ের সামনে দিয়ে আইএসএফ কর্মীরা ম্যাটাডোরে করে আসছিলেন তখন তাদের ওপর হামলা চালায় আরাবুল বাহিনী। ভাঙা হয় নৌশাদ সিদ্দিকির গাড়ি। আহত হন তিনি। যেই আরাবুল বাহিনী সেদিন হামলা চালালো সেই আরাবুল বহাল তবিয়াতে ঘুরছে। আর ২১ তারিখ ভাঙড়ের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন নৌশাদ সিদ্দিকি সহ বহু আইএসএফ কর্মী। তার মধ্যে রয়েছে একজন নাবালকও। 

১ ফেব্রুয়ারি নৌশাদ সহ বাকিদের আদালতে তোলা হলে ১৫ তারিখ পর্যন্ত ফের জেল হেফাজত হয়েছে সবার। সেদিন পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে নৌশাদ সিদ্দিকি বিজেপি’র সঙ্গে টাকার লেনদেন করেছে। এই অভিযোগ কতোটা সত্য তা সময় বলবে। সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী বলছেন, ‘‘পুলিশ এখন যতো পারছে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে।’’ 

একজন বিধায়ক গ্রেপ্তার। চুপ করে রয়েছে নিজেদের প্রধান বিরোধী দল বলে দাবি করা বিজেপি। শাসক দল তো চুপ থাকবেই।

নৌশাদ সিদ্দিকি গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের নেমেছেন সিপিআই(এম) কর্মীরা। প্রতিবাদ গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণে। মুক্তির দাবি জানিয়েছেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেছেন, ‘‘একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আসার অধিকার থাকবে না?’’ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বামফ্রন্ট। বামফ্রন্ট কর্মীরা রাস্তাতেও নেমেছেন রাজ্যের সর্বত্র।  

ডায়মন্ডহারবারে এমন প্রতিবাদ সভা বানচাল করার চেষ্টায় কোনও খামতি রাখেনি ‘ভাইপো বাহিনী’। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ যখন পাল্টা দেয় সেটা ভয়ঙ্কর প্রতিরোধ হয়। ডায়মন্ড হারবারেও তাই হয়েছে। পাল্টা প্রতিরোধ, জমায়েত, মানুষের মেজাজের কাছে হার মানে তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী।

লাহিড়ীকে বলছেন, ‘‘শুধু আরাবুল ইসলাম নয়। গোটা ভাঙড় এবং রাজ্যে যারা বন্দুক নিয়ে ঘুরছে, মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে তারা জেলের বাইরে পুলিশ তাদের সেলাম করছে। আর যারা প্রতিবাদ করছে তাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে’’

রাজ্যে ২০১১ সালে তৃণমুল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিধানসভার ভিতর হোক বা রাস্তায় বিরোধী দলের বিধায়ক বিশেষত বামপন্থী বিধায়কদের ওপর আক্রমণ হয়ে আসছে। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর বিধানসভার ভেতরেই শারীরিক আক্রমণ করা হয় সেই সময়ে সিপিআই(এম) বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়, দেবলীনা হেমব্রম এবং মাফুজা খাতুনকে। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাঁদের।

তার পরের বছর ভাঙড়ে আক্রান্ত হন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা সেই সময়ে তিনি সিপিআই(এম)’র নেতা, ভাঙড়ের বিধায়কও। হামলার অভিযোগ ছিল আরাবুল ইসলামের দিকেই। পরে অবশ্য রেজ্জাক মোল্লা তৃণমূলে যাওয়ার পর আরাবুলের সঙ্গে মিশে যান। এই আরাবুল কেবল সিপিআই(এম) নেতা-কর্মীদের ওপর হামলায় অভিযুক্ত এমন নয়। 

তারপর ভাঙড়ে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় সিপিআই(এম)’র কর্মসূচির ওপর। পঞ্চায়েত, লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনে ২০১১ সালে পর থেকে বিরোধীদের ওপর আক্রমণ ছিল রোজকারের ব্যাপার। যে ভাবেই হোক দখল করতেই হবে বুথ, এলাকা। চালিয়ে যেতে হবে সিন্ডিকেট রাজ। তাই তার জন্য ভোটের সময় সকাল থেকেই শোনা যেত বোমার আওয়াজ। মানুষ নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। আর আজ সেই আরাবুল সংবাদমাধ্যমে বলছে, ‘‘ভাঙড়কে যে অশান্ত করেছে সে জেলে গিয়েছে।’’ 

যেই আরাবুল ইসলাম এই কথা বলছেন তার বিরুদ্ধে ২০১১ সালের পর ভুরি ভুরি অভিযোগ উঠেছে সিপিআই(এম) কর্মীদের ওপর হামলা চালানোর। ভাঙড় কলেজে শিক্ষিকাকে জলে জগ ছুঁড়ে মারা এর মধ্যে একটি

তাহলে হাতিশালা মোড়ে নৌশাদ সিদ্দিকির গাড়ি ভাঙলো কারা? বোমা ছুঁড়লো কারা?

কেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় এতো লোভনীয় তৃণমূলের কাছে? 

দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং উত্তর ২৪ পরগনার মাঝে হচ্ছে ভাঙড়। ভেড়ি থেকে শুরু করে লেদার কারখানা সব কিছু রয়েছে ভাঙড়ে। আর এই ভেরি দখল। সিন্ডিকেট। নিউ টাউনে যেই বাড়ি তৈরি হচ্ছে তার জন্য ইট, বালি সাপ্লাই করবে এই সিন্ডিকেট। ভেরি দখল করে তাতে বাড়ি তৈরি করা। জমি দখল করা। সব কিছুতেই নাম আরাবুল বাহিনীর। 

আবার এই বাহিনী ভাঙড়ে ভোট করিয়ে সোনারপুর, যাদবপুর, বারুইপুরে আসে ভোট করাতে। ওদের ভোট করানো মানে, মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া। 

ভাঙড়ের একটা বড় অংশের মানুষ কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। হয় কেউ নিজের জমিতে চাষ করে বা খেত মজুরের কাজ করেন। এমনই একজন হলেন সুধা সুই। আরাবুল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আরাবুল ইসলাম ভাঙড় এবং সওকাত মোল্লা ক্যানিংয়ের মানুষজনের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। কেউ ওদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে পারে না। নিজেদের ইচ্ছা মতো সব কিছু করছে। গরিব মানুষের থেকে অনৈতিক ভাবে তোলা আদায় করে ওদের লোকেরা।’’ সুইয়ের কথায়, প্রতিবাদ করলে তাঁর কাছ থেকে মোটা টাকার জরিমানা নেবে তৃণমূল। 

কেন নৌশাদ সহ বামপন্থীরা বার বার আক্রান্ত?     

২০২১ সালে বিধায়ক হওয়ার পর নৌশাদ চেষ্টা করেছিল ভাঙড়ের মানুষ যাতে স্বনির্ভর হতে পারে। তার জন্য ভেরি, পোলট্রি ব্যবসার প্রসারে চেষ্টা করেন তিনি। আর সেখানেই আঁতে ঘা খায় তৃণমূল। তৃণমূলের বেআইনি ভাবে ভেরি দখলের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকি। তৃণমূলের সিন্ডিকেট ব্যবসা সমস্যার মুখে পড়তে শুরু করে। 

তাই বিধায়ক যাতে এলাকায় না থাকতে পারে, তাকে কেউ যেন বাড়ি ভাড়া না দেয় তার ফতোয়া জারি করে তৃণমূল। নৌশাদকে জাতীয় পতাকা তুলতেও বাধা দেওয়া হয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভাঙড় নিজেদের দখলে রাখতে চায় আরাবুলরা আর তাই গ্রেপ্তার হলেন ‘আক্রান্ত বিধায়ক’। বাইরে বহাল তবিয়াতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ‘হামলাবাজ’ আরাবুল। 

দুষ্কৃতী-দুর্নীতি সিন্ডিকেটের গণতন্ত্র কেড়ে নেওয়ার আরেক নমুনা বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকির জেল।  

 

Comments :0

Login to leave a comment