পঙ্কজ কুমার দত্ত
আপামর কলকাতাবাসী কর্মক্লান্ত দেহ নিয়ে রাতের বেলা ঘুমোতে যান এই বিশ্বাসে যে তাঁদের সকলের মাথার উপর অতন্দ্র প্রহরীর মতন ছাতা ধরে আছেন ভারতগর্ব লালবাজার। এই লালবাজার হলো একশো সাতষট্টি বছরের পুরানো কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর যেখানে কলকাতা পুলিশের মহামহিম নগরপাল তাঁর অধীনে থাকা পুলিশের যাবতীয় কাজকর্মের নজরদারিতে সদা ব্যস্ত থাকেন। এমনটাই বলা হয়ে থাকে।
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের রাজধানীর গৌরবে ভূষিত কলকাতার অহঙ্কারের থাকার একটি কারণ হলো যে সারা ভারতবর্ষে সমস্ত পুলিশ কমিশনারেটের সিপি বা কমিশনার অব পুলিশরা তাদের নিজ নিজ রাজ্যের ডিজি বা ডাইরেক্টর জেনারেল অব পুলিশের অধীনে তাঁদের কর্মকাণ্ড নির্বাহ করেন; কিন্তু কলকাতা পুলিশের সিপি এরাজ্যের ডিজি বা পুলিশের মহানির্দেশকের অধীনে থাকা পুলিশ কর্মচারী নন। সূচনালগ্ন থেকে আজও এই গৌরবপ্রবাহ অবিকল বহাল আছে। অর্থাৎ কলকাতা পুলিশ কমিশনারের পদমর্যাদা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের পুলিশ কমিশনারদের থেকে পৃথক। সব গোত্রের কলকাতাবাসীও সে গর্বের অংশীদার। সেই কলকাতাবাসী, এরাজ্য, গোটা দেশ এমনকি সাগরপারের মানুষ প্রত্যক্ষ করলেন লুম্পেনরাজের গ্রাস।
কলকাতাবাসী এবারের স্বাধীনতা দিবসের কয়েকদিন আগে এক বিরল অপরাধ প্রত্যক্ষ করল। মহাগুরুত্বপূর্ণ জনপদ শ্যামবাজারের থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের এমডি পাঠরতা এক ডাক্তার ছাত্রী ৩৬ ঘণ্টা কঠোর মেডিক্যাল পরিষেবা প্রদানের পর চেষ্ট বিভাগের কাছে থাকা একটি সেমিনার কক্ষে ধর্ষিতা হয়ে খুন হলেন। এরকম ঘটনা এ বাংলা ইতিপূর্বে কোনও রাজত্বেই দেখেনি। বাঙালি চেতনা ও অহং-এ এ ঘটনা এক গভীর অভিঘাতের জন্ম দিল। আপাত নিরীহ বাঙালির মননে আলোড়ন তৈরি করা এই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা অনেক প্রশ্নের জন্মও দিল। এই ঘটনাতে ঘৃতাহুতি পড়লো স্বাধীনতা দিবসের প্রাককালে মধ্যরাতে ঘটে যাওয়া আর এক ঘটনার।
Freedom at Midnight শব্দবন্ধের সঙ্গে আমাদের সকলের অল্পবিস্তর পরিচিত আছে। কিন্তু এবারের Freedom at Midnight আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অনুভব করল সম্পূর্ণ অন্যরূপে। লুম্পেনদের এমন খুল্লাম খুল্লা ‘লুম্পেনরাজ’ এই হাসপাতালটি প্রত্যক্ষ করল টানা চল্লিশ মিনিট সময় ধরে। প্রথমোক্ত ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল তা সাইক্লোনের মতো আছড়ে পড়লো পশ্চিমবঙ্গের নানা অংশে। ১৪/১৫র’ সেই রাতে আবার কলকাতার রাজপথ দখল করে নিয়েছিল এ রাজ্যের প্রতিবাদী মুক্তমনা নারীরা। সেই সম্মিলিত আওয়াজের সাথে পরবর্তী যুদ্ধ হলো সল্টলেক যুবভারতীতে ঘটে যাওয়া আর এক কর্মকাণ্ডজনিত মহা কোলাহল। ঐতিহ্যমণ্ডিত ডুরান্ড কাপের ডার্বি ম্যাচ বাতিলের প্রতিবাদে শামিল হাজার হাজার যুবক-যুবতীকে সামাল দিতে এ রাজ্যের প্রশাসন আক্ষরিক অর্থে চোখে সর্ষেফুল দেখল।
এই তিন ঘটনাপ্রবাহ পরিপূর্ণভাবে শুধু বঙ্গে জনমানসকেই আচ্ছন্ন করেনি। সাগরপারের মানুষও ঘটে যাওয়া সেসব ঘটনার তীব্র প্রতিবাদে শামিল হলেন। এমন অভূতপূর্ণ জনবিক্ষোভ এ রাজ্য এর আগে শেষ কবে এসব প্রত্যক্ষ করেছে তা অনেকেই মনে করতে পারবেন না। সবকিছু ছাপিয়ে যে সব প্রশ্নচিহ্ন জনমানস আচ্ছন্ন করছে তা নিম্নরূপ :
(১) আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে যেখানে এম ডি পাঠরতা ছাত্রী খুন হলেন সেখানে কি সিসি ক্যামেরার নজরদারি ছিল? যদি না থাকে তবে কেন?
(২) স্থানীয় থানাতে প্রথমেই কেন আরজি কর হাসপাতালের কোনও বড় মাপের আধিকারিক এই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা লিখিতভাবে জানালেন না।
(৩) স্বতঃপ্রণোদিত মামলা কি পুলিশ দায়ের করতে পারতেন না?
(৪) নির্যাতিতার মেডিক্যাল ছাত্রীর পোষ্ট মর্টেম কি সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ ছিল?
(৫) কলকাতা পুলিশ যে ব্যক্তিকে প্রেফ্তার করল তার পরিচয়দানে পুলিশকর্তারা কেন এত দ্বিধায় ছিলেন?
(৬) আটক ঐ ব্যক্তি কিভাবে বিনা বাধায় আর জি কর-এর সেমিনার কক্ষে প্রবেশাধিকার পেলেন?
(৭) মৃতার দেহ দাহ করার ক্ষেত্রে কলকাতা পুলিশের মহাব্যস্ততার কারণ কি শুধুই আইন-শৃঙ্খলা জনিত নাকি অন্য কিছু?
(৮) মৃতার পরিবারের প্রথমে রাজ্য প্রশাসনের প্রতি অটল আস্থা আর তার কিছু দিন বাদে ভিন্নতর অবস্থান গ্রহনের কারণ কি?
৯) শাসকদলের রাজ্যসভার দুই মাননীয় সদস্য কেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপারের প্রতি এত অনাস্থা প্রকাশ করলেন?
১০) রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের বড় কর্তারা কি এসবের কিছুই জানতেন না?
১১) রাজ্য শাসকদলের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে আস্থা ঘোষণা করা এক নামজাদা অধ্যাপক তথা চিকিৎসক কেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ প্রশাসন সম্বন্ধে প্রকাশ্যে অনাস্থা স্থাপন করলেন?
১২) এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরে একজন পূর্ণমন্ত্রী নেই কেন?
১৩) Freedom at Midnight-এর পরিবর্তে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে কেন ‘লুম্পেন রাজ’ ৪০ মিনিট ধরে প্রত্যক্ষ্য করল?
১৪) কলকাতা পুলিশ অতি দ্রুততার সাথে ব্যবস্থা নিতে অযথা কালবিলম্ব করেছিল কেন?
১৫) মহামহিম কলকাতা পুলিশ কমিশনার লালবাজারে তাঁর সাংবাদিক বার্তায় ১৪ তারিখের আর জি করের ঘটনাকে Assessment Failure বলেছিলেন।
১৬) মহামাহিমা মণ্ডিত কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ সত্যি কি ১৪ তারিখের আর জি কর ক্যাম্পাসে ঘটনার আগাম তথ্য পরিবেশন করতে ব্যর্থ হয়েছিল?
১৭) ১৮ তারিখের সল্ট লেকে অনুষ্ঠিত ডার্বি ম্যাচ বাতিল করার কারণ কি পুলিশি সংখ্যাল্পতা না অন্য কিছু?
১৮) রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের সাথে কি রাজ্য পুলিশ ও কলকাতা পুলিশের নিবিড় যোগাযোগ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল?
১৯) রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর গত ১৪ তারিখে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি পরিমাণে ও পরিমাপে জানাচ্ছেনা কেন?
২০) লালবাজারের বড়কর্তারা কি ১৪ তারিখে দুষ্কৃতীদের হাতে আঘাতপ্রাপ্ত ও নিগৃহীত (যদি হয়ে থাকে) পুলিশ কর্মচারীদের কথা পদ অনুযায়ী জানাবেন?
২১) এ সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে এ রাজ্যের সরকার ও প্রশাসন একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে কি ?
গত ১০ দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে এ রাজ্যের নাগরিক জনমানসে যে অপরিসীম প্রশাসনিক ‘ক্ষত’ তৈরি হয়েছে তা দূরীকরণে কি এই রাজ্য সরকার কোন ভূমিকা পালন করবে? এ সব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য রাজ্যবাসীর উৎকণ্ঠা কিন্তু ক্রমবর্ধমান।
(লেখক রাজ্যের প্রাক্তন আই জি)
Comments :0