Editorial 8th feb

নজিরবিহীন নিষ্ঠুরতা

সম্পাদকীয় বিভাগ

নির্ধারিত ব‌য়সের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ে করার অপরা‍‌ধে গত পাঁচদিনে প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করে জেলে পু‍‌রেছে আসামের বিজে‍‌পি সরকার। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যোগ্য শিষ্য মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত‍‌ বিশ্বশর্মার নির্দেশে এমন পাইকারি হারে গ্রেপ্তারকে পুলিশ নাম দিয়েছে ‘অবৈধ স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযান।’ মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবার পর গত দেড় বছরে এমন চমক-নাটক করেই তিনি নিজেকে জাহিরকরা কৌশল নিয়েছেন। কার্যক্ষেত্রে পদে পদে ব্যর্থতা আড়াল করতে এবং পাশাপাশি রাজ্যে অশান্তি-অস্থিরতা তৈরি ক‍‌রে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে তীব্র করতে আরএসএস’র নির্দেশে তিনি এপথ বেছে নিয়েছেন। তিনি মনে করছেন এভাবে অমানবিক নিষ্ঠুরতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা দিয়ে মানুষকে ভাগ করে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি পুষ্ট করবেন।


মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে পুলিশ চার সহস্রাধিক নামের তালিকা তৈরি করে রাজ্যজুড়ে একযোগে ধরপাকড় শুরু করেছে। মধ্যরাতে বাড়ি ঘিরে ফেলে ঘুম থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে ভয়ঙ্কর দাগী অপরাধীর মতো। লক্ষ্য করার বিষয় যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাদের সকলেই অতি দরিদ্র খেটে খাওয়া, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ আর বেশিরভাগই ধর্ম পরিচয়ে মুসলিম। যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাদের সিংহভাগই পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। গ্রেপ্তারের পর অনেকের পরিবারে হাঁড়ি চড়া বন্ধ হয়েছে। কারো ঘরে একাধিক সন্তান আছে। আরো স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। এমন এক বিপর্যয়কর অসহায় পরিস্থিতিতে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্যরা থানায় থানায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। থানার সামনে বসে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দরিদ্র মানুষকে এভাবে অনিশ্চিত অসহায়তার ‍‌দিকে ঠেলে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাদের খাদ্য ভিক্ষা দেবার কথা বলছেন। এই হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি।
বাল্যবিবা‍‌হ নিঃসন্দেহে অপরাধ। তা কমাতে গণতান্ত্রিক দেশের আইন থাকবে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করে অসহায় পরিবারগুলিকে পথে বসানোর মধ্যে নিহিত থাকতে পারে না। হিমন্তকে আগে জানতে ও বুঝতে হবে এই সমস্যার মূল কারণ কি? কোন আর্থ-সামাজিক অবস্থা বাল্যবিবাহের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। তথ্য পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞদের মত এটাই বাল্যবিবাহে কারণ লুকিয়ে আছে দারিদ্র্য ও অশিক্ষার মধ্যে। যে‍‌ মেয়েরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, দারিদ্রে জর্জরিত, যারা কাজের সুযোগ পায় না, যাদের ক্ষমতায়নের অবস্থা নেই সেই মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিক্ষার হবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তেমন পরিবারও বোঝা হালকা করতে মেয়েদের বিয়ে দেবার উদ্যোগ নেয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বশর্মার দায় ছিল দারিদ্র্য হ্রাসের ব্যবস্থা করা।  শিশু শিক্ষাঙ্গ‍‌নে জায়গা করে দেওয়া, মেয়েদের স্বাবলম্বী হবার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেকাজে তিনি একশ ভাগ ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতা ঢাকতেই তিনি হিন্দুত্ববাদী অমানবিক নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছেন।


নারীদের অবস্থার বিচারে দেশে নিকৃষ্ট রাজ্যগুলির অন্যতম আসাম। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী জন্মের এক বছরের মধ্যে প্রতি হাজারে ৩১ শিশুর মৃত্যু হয় আসামে। ৩২ শতাংশ মায়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের কমে। স্বাস্থ্যকর সন্তান প্রসবে দেশে সবচেয়ে নিচে আসাম। নারীর ক্ষমতায়নের সূচকেও শে‍‌ষের দিকে। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ২০ শতাংশ কোনোদিন স্কুলে যায়নি। মাত্র ৩০ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যন্ত মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। ১৭ শতাংশ মহিলা অকৃষি কাজে যুক্ত। তাও ৮০ শতাং‍শেরই বেশিরভাগ সময়ে কাজ থাকে না। মহিলাদের জমির মালিকানা নেই বললেই চলে। এমন একটি ব্যর্থ রাজ্যের মাথায় বসে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছেন হিমন্ত। হয়তো তিনি জানেন না তাঁরই নেতা যার নেতৃত্বে দেশ চল‍‌ছে তিনি ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন ১২ বছরের ‍কিশোরীকে। মস্তিষ্কে অন্ধ হিন্দুত্ব গজগজ করলে এটা বোঝার ক্ষমতা থাকে না যে পুলিশ দিয়ে বাল্যবিবাহ কমানো যায় না তার জন্য দরকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও চেতনার বিকাশ।
 

Comments :0

Login to leave a comment