Editorial

দলিত প্রেম

সম্পাদকীয় বিভাগ


প্রধানমন্ত্রী বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীদের মুখে দলিত প্রেম ইদানীং বেশ প্রবল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলিত প্রেমের বাহুল্য অনেকের মনেই সন্দেহের উদ্রেক করে। আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের রাজনৈতিক প্রকল্পের অনুসারী আরএসএস-বিজেপি জানে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাধ্যমে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করে হিন্দুদের এককাট্টা করার চেষ্টা হলেও বর্ণবাদী মানসিকতা সেই পথে প্রধান অন্তরায়। দলিত ও জনজাতি মানুষকে বর্ণহিন্দুত্বের রাজনৈতিক ঘেরাটোপে আনা সহজ নয়। অথচ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত-জনজাতি মানুষের সমর্থন না মিললে ভোট বৈতরণী পার হয়ে ক্ষমতার সিংহাসন দখল করা যাবে না। এই বাস্তবতাই বিজেপি-কে দলিত দরদি সাজতে বাধ্য করেছে। দলিত ভোটারদের একটা বড় অংশ আরএসএস’র ঝোলায় ঢোকানো না গেলে মোদী-শাহ’দের কোনোদিনই ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হবে না। তাছাড়া জাতভিত্তিক জনগণনা নিয়ে যখন দেশময় তোলপাড় চলছে তখন বিষয়টি যথাসম্ভব চাপা দেবার জন্যও জরুরি হয়ে পড়ে দলিত প্রেমের প্লাবন ডাকা। জাতভিত্তিক জনগণনা হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর প্রকৃত অবস্থাটা প্রকাশ্যে চলে আসবে। বাইরে তথাকথিত উন্নয়ন বা বিকাশের জলুসের আড়ালে ঘোর অন্ধকারে ঢাকা পড়া তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি’দের দুঃসহ জীবন সামনে চলে এলে মেরুকরণের মাধ্যমে ভোটে জয় সহজসাধ্য হবে না। অতএব জাতভিত্তিক জনগণনা ঠেকাতে দলিতদের এমনভাবে ভুল বুঝিয়ে আবেগতাড়িত করতে হবে যাতে তার নিজেদের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। বৃহত্তর ধর্মীয় বিভাজনের জালে জড়িয়ে জীবনযন্ত্রণাকে কৃতকর্মের ফল হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। ভোটের আগে মোদী-শাহ’রা সেই কৌশলই কাজে লাগিয়েছেন এবং সন্দেহ নেই দলিত-আদিবাসীদের ভুল বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করে তাদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন।
ভোটের জন্য মোদীদের দলিত প্রেম উথলে উঠলেও মোদী জমানায় কেমন আছেন তা সরকারি তথ্যেই উলঙ্গ হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে শুধু জাতপাতের বৈষম্য, সামাজিক শোষণ, নির্যাতন নয় আর্থিকভাবেও সঙ্কটে জর্জরিত দলিতরা ক্রমবর্ধমান হারে বিপন্নতা বোধ করছেন। তাদের জীবনে অনিশ্চয়তা ও হতাশা বাড়ছে। শিক্ষাঙ্গন‍‌ থেকে মাঝপথেই বেরিয়ে যাচ্ছে দলিত পড়ুয়ারা। মোদী সরকার শিক্ষায় সর্বত্র খরচ বৃদ্ধির ফলে দলিত পড়ুয়াদের পক্ষে সেই বর্ধিত ব্যয় বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। তেমনি দলিত পরিবারের আয় না বাড়ায় শিক্ষার আনুষঙ্গিক ব্যয়ভারও তাদের পক্ষে বহন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই মাঝপথেই তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি, আইআইএম থেকেই সাড়ে তেরো হাজারের বেশি দলিত পড়ুয়া মাঝপথে পড়া ছেড়ে চলে গেছে। পাশাপাশি আরও ভয়াবহ তথ্য মিলেছে সরকারি রিপোর্ট থেকে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ৩৭ হাজার দলিত পড়ুয়া আত্মঘাতী হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে অপমান, লাঞ্ছনা, অত্যাচার যেমন পড়ুয়াদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে তেমনি পারিবারিক আর্থিক সঙ্কট, ঋণগ্রস্ততা তাদের হতাশার মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এই দলিত সমাজকেই সচেতনভাবে প্রতারণা করে মোদীরা ক্ষমতার ভিত পোক্ত করতে চাইছে।

Comments :0

Login to leave a comment