‘হিসাব পাওয়া যায়, কিন্তু উপলব্ধি করা যায় না।’ এটি একটি স্লোগান। চলছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়।
কিন্তু কার জন্য সেই স্লোগান? শালবনী, ময়না, সাগরদ্বীপ— সর্বত্র এক জবাব— ‘যার হিসাব পাওয়া যায়, কিন্তু দেখা যায় না, তা হলো কর্মশ্রী।’ মুর্শিদাবাদের মদনপুর পঞ্চায়েতের প্রধান, সিপিআই(এম) নেতা নাজিমুল হকের কথায়,‘‘প্রকল্পটার ঘোষণা শুনছি। বিজ্ঞাপন দেখছি। জেলা, ব্লক প্রশাসনের হিসাবেও দেখছি। কিন্তু কারা কাজ করছে, মজুরি কোথায় যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না।’’
তৃণমূলের প্রধান, উপপ্রধানরা কী বলছেন?
একবছর হয়ে গেল আপনি প্রধান হয়েছেন। এই একবছরে পঞ্চায়েত কী করল? প্রশ্নটি করা হয়েছিল কুলতলির জালাবেড়িয়া-২ পঞ্চায়েতের প্রধান স্বপন সর্দারের কাছে। গ্রামে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একজন মারা গেছেন। আরও গ্রামবাসীদের পিছু পিছু সেদিকেই যাচ্ছিলেন তৃণমূল নেতা। বললেন,‘‘কাজ কোথায় পঞ্চায়েতে? টাকাই নেই।’’ কোনও টাকা নেই? এবার বললেন,‘‘ফিফটিনথ ফিনান্স কমিশনের কিছু টাকা পেয়েছিলাম আমরা। তাতেই যতটুকু কাজ হয়।’’ তারপর নিজেই যুক্ত করলেন,‘‘খুবই অল্প টাকা। ১৯টি বুথ। পেয়েছিলাম ধরুন ৮৪লক্ষ টাকা। বুথ পিছু ৫লাখও হয় না। এতে কী হয়?’’ তবে পঞ্চায়েত চলবে কী করে? তৃণমূল নেতার কথায়,‘‘তাহলেই বুঝুন। রেগার কাজ নেই। আবাসের টাকা নেই। পথশ্রীতে কিছু রাস্তার কাজ হচ্ছে।’’ কিন্তু পথশ্রী তো পঞ্চায়েতের কাজ নয়। গ্রামের মানুষের কাজের সমস্যা তো পথশ্রীতে হবে না। একমত হলেন প্রধান। বললেন,‘‘জানি না কী হবে। মমতাদিদি আর অভিষেক কী করে দেখা যাক। নিশ্চই কিছু করবেন ওনারা।’’
আর কর্মশ্রী? জালাবেড়িয়া-২ নং পঞ্চায়েতের প্রধানের উত্তরের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে হুবহু মিল নন্দীগ্রামের মোহাম্মদপুরের উপপ্রধান কিংবা সাগরের ঘোড়ামারা পঞ্চায়েতের সদস্য সঞ্জীব সাগরের বক্তব্য এক। মোহাম্মদপুরের উপপ্রধান জানালেন,‘‘কর্মশ্রী প্রকল্পের কোনও কাজ শুরু হয়নি আমার এখানে। কাল(সোমবার) ব্লকে মিটিং ডেকেছে। দেখা যাক কিছু বলে কিনা।’’ আর সঞ্জীব সাগরের কথায়,‘‘আমাদের এলাকায় কর্মশ্রী প্রকল্প চালু হয়েছে। কিছু রাস্তা হচ্ছে। আমরা পঞ্চায়েত থেকে জবকার্ড নম্বর টম্বর দিয়ে দিচ্ছি।’’ কাকে দিচ্ছেন? সঞ্জীব সাগরের কথায়,‘‘ঠিকাদারকে দিয়ে দিচ্ছি।’’ আর মজুরি? উত্তর,‘‘তাও ঠিকাদার দিচ্ছে।’’ তাহলে কাজের মাস্টার রোল, এফটিও কিছু হচ্ছে না? গোড়ামারার তৃণমূল নেতার কথায়,‘‘না, সেসব হচ্ছে না।’’ জালাবেড়িয়া-২নং পঞ্চায়েতের প্রধানও বলতে পারেননি তার পঞ্চায়েতে মুখ্যমন্ত্রীর ওই প্রকল্পটির কী অবস্থা।
আসল বিষয়টি আরও অদ্ভুত। মমতা ব্যানার্জি ৫০দিন কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এই প্রকল্পে। প্রকল্পের নাম কর্মশ্রী। কিন্তু এই কাজ করছে ঠিকাদার। কিছু রাস্তা, পুকুরের ঘাট সহ কাজ হচ্ছে। রাজ্যের পঞ্চায়েত দপ্তরের এক আধিকারিকের কথায়,‘‘এরসঙ্গে পঞ্চায়েতের কোনও সম্পর্ক নেই। ঠিকাদার নিজের পছন্দ মতো কয়েকজনকে বেছে নিচ্ছে। কাজ হচ্ছে অন্য দপ্তরের। ধরা যাক পূর্ত দপ্তরের কাজ হচ্ছে। ঠিকাদার সরকারের থেকে টাকা পেলে সে মজুরি দেবে। সে হিসাব দিচ্ছে কাজের। সেই ঠিক করছে কত দিনের কাজ হলো। কিন্তু এখন কেউ মজুরি পাচ্ছে না।’’ দপ্তরের আর এক আধিকারিকের কথায়,‘‘পুরোটাই অদ্ভুত। সব কাজ হচ্ছে কাগজে। কিন্তু একটি ভবন বানানোর মতো কাজে ঠিকাদার একশো দিনের কাজের জবকার্ডধারী গ্রামবাসীকে নেবে? তার দরকার দক্ষ শ্রমিক। সেই শ্রমিক কখনও রেগার নির্দ্ধারিত মজুরিতে কাজ করবেন?’’
মুর্শিদাবাদের মদনপুরের প্রধান নাজিমুল হকের কথায়,‘‘কোথায় কর্মশ্রীর কাজ? শুধু কাগজে কলমে চলছে। যা হচ্ছে ব্লকের অফিসাররা জানে। আমাদের পঞ্চায়েতে সেই কাজ চোখেই পড়ছে না।’’
প্রমাণ কর্মশ্রীর হিসাবেও। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা পরিষদের এক আধিকারিকের কথায়,‘‘আমাদের জেলায় গত ১২জুলাই পর্যন্ত কর্মশ্রী প্রকল্পের একটি পর্যালোচনা হয়েছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, কর্মশ্রী প্রকল্পে গড়ে চলতি আর্থিক বছরে ৫৭.২৮দিন করে শ্রমিকদের কাজ দেওয়া হয়েছে।হলদিয়া ব্লকে নাকি ৬৫দিন কাজ করেছেন শ্রমিকরা। আর্থিক বছরে ১২ জুলাই পর্যন্ত ১০৩দিন। ১০৩দিনের মধ্যে জেলায় গড়ে ৫৭দিনের বেশি কাজ হয়ে গেলো, হলদিয়ায় ৬৫দিন কাজ হলো, ময়নায় ৬৯দিন কাজ হয়েছে, আর আমরা কিছু দেখতেই পেলাম না?’’
কর্মশ্রী তাহলে কী? পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনী ব্লকের এক পঞ্চায়েত কর্মীর দাবি,‘‘আমাদের স্লোগান কী জানেন? হিসাব পাওয়া যায়, কিন্তু দেখা যায় না কী? কর্মশ্রী।’’
কিন্তু রাজ্য সরকারের হিসাব বলছে, চলতি আর্থিক বছরের এই ৩মাস ২৭দিনে ১৪লক্ষ ৮০হাজার ১০৪জন গ্রামবাসী জবকার্ডধারী এই প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন। তাঁদের মজুরি বাবদ দেওয়া হয়ে গেছে ১৪৪২কোটি ১৮লক্ষ টাকা। শ্রমিকরা গড়ে প্রায় ৪৯দিন কাজ করে ফেলেছেন!
Comments :0