Ration Scam

হাসপাতাল থেকে মেয়ের উদ্দেশে লেখা বালুর চিঠিতে রেশন দুর্নীতির ছবি বেআব্রু

রাজ্য

‘জেল হেপাজতে’ থাকা অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মেয়েকে লেখা চিঠিই রেশন দুর্নীতির ভয়াবহ ছবিকে আরও সামনে এনেছে। সেই চিঠি এখন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে। সেই চিঠিতে জেল হোপাজতে থাকাকালীন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তাঁর মেয়েকে কার কাছে কত টাকা রাখা আছে, কত টাকার সুদ পাওয়া যাবে জানিয়েছিলেন। এমনকী প্রয়োজনে সন্দেশখালির বাহুবলী শাহজাহান শেখের কাছ থেকে টাকা চাইতে ‘নির্দেশ’ দিয়েছিলেন প্রিয়দর্শিনী মল্লিককে!

কালীঘাটের কাকুর কণ্ঠস্বরের নমুনার পরীক্ষার মতো রেশন দুর্নীতিতে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের চিঠির হাতের লেখা পরীক্ষা করাতে ইতিমধ্যেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে ইডি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আইনজীবী জানিয়েছেন হাসপাতালে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ওপর নজরদারি রাখার জন্য সিআরপিএফ মোতায়েন করা হয়েছিল। সেই বাহিনীর হাতেই  গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর একটি চিঠি আসে। সেটি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক হাসপাতালে থাকা অবস্থায় দেখা করতে আসা তাঁর মেয়ের কাছে খামে ভরে দিয়েছিল। সেই চিঠি নিয়ে বেরোনোর সময় ধরা পড়ে যান তাঁর কন্যা। সেই চিঠি আদালতেও পেশ করেছিল ইডি। মেয়েকে বাংলা ও ইংরেজি বাক্য মিশিয়ে লেখা চিঠিতে একাধিক নির্দেশ দেওয়া ছিল, তাঁকে একাধিক আর্থিক লেনদেনের তথ্যের ইঙ্গিতও ছিল। বিপুল পরিমাণ টাক লেনদেন, দেওয়া নেওয়ার হিসাবও ছিল। সেখানে শাহজাহানের, শঙ্কর আঢ্যের পাশাপাশি রেশন দুর্নীতিতেই ধৃত আলিফ নুর ওরফে মুকুলের নাম। ইডি’র তরফে দাবি করা হয়েছে, ঐ চিঠি তাদের হাতে আসার পরেই গত ১৯ ডিসেম্বর জেরায় চিঠি লেখার বিষয়টি স্বীকার করে নেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। 

এসএসকেএম’র বিছানায় শুয়ে মেয়ের হাত দিয়ে পাঠানো সেই চিঠিতে ধৃত জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক উল্লেখ করেছিলেন ‘‘কাউকে টাকা দেওয়ার প্রয়োজন হলে মুকুল, শাহজাহান এবং ডাকু টাকা দেবে। মুকুল মাসে ১০ লক্ষ করে দেবে। এটা সুদের টাকা। মূল টাকাও ওর কাছেই আছে। ওতে হাত দিও না।’’ এখানে মুকুল মানে রেশনকাণ্ডে ধৃত দেগঙ্গার তৃণমূলী নেতা বিদেশের ভাই মুকুল। 

এখানে সুদের টাকা বলতে কী বোঝানো হয়েছে? তদন্তকারী সংস্থার দাবি রেশন দুর্নীতির টাকার একটা অংশ বাকিবুরের মাধ্যমে রাখা আছে দেগঙ্গার এই তৃণমূলী নেতার কাছে। সেই টাকারই সুদ চেয়েছিল জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। 

প্রতিমাসে আসল বাদ দিয়ে কেবল সুদের দশ লক্ষ টাকা মুকুলের কাছ থেকে নেওয়ার কথা বলেছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। যদি সুদের অঙ্কই মাসে দশ লক্ষ টাকা হয় তবে আসলের পরিমাণ কত, সেই অঙ্ক কষতেই দেখা গেছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। ছয় শতাংশের হিসাবে সুদ ধরলে ২০ কোটি টাকার সুদ হয় মাসে ১০ লক্ষ। রেশন দুর্নীতির এই টাকাই মুকুলের হেপাজতে রেখেছিল বালু। জেলে থাকা অবস্থায় সেই টাকার সুদই মেয়েকে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। এই দশ লক্ষ টাকা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকেরই নিয়ন্ত্রণে থাকা তিনটি সংস্থায় পাঠিয়ে দিত মুকুল। শ্রী হনুমান রিয়েলকন প্রাইভেট লিমিটেড, গ্রেসিয়াস ইনোভেটিভ প্রাইভেট লিমিটেড, গ্রেসিয়াস ক্রিয়েশান প্রাইভেট লিমিটেড। তিনটি সংস্থাতেই ২১’ সাল পর্যন্ত বালুর স্ত্রী ও কন্যা ডিরেক্টর ছিলেন। বর্তমানে ডিরেক্টর তাঁর বাড়িতেই পরিচারকের কাজ করা রামস্বরূপ শর্মা। তদন্তকারী সংস্থার দাবি আদপে এই সংস্থাগুলি সবই শেল বা শিখণ্ডী সংস্থা। মূলত মানি লন্ডারিংয়ের জন্যই ব্যবহৃত হয়। 

জেলে থাকা অবস্থায় ধৃত প্রাক্তন মন্ত্রী এমনকি তাঁর মেয়েকে জানিয়েছিলেন যে, ‘‘কাউকে টাকা দেওয়ার প্রয়োজন হলে মুকুল, শাহজাহান এবং ডাকু টাকা দেবে।’’ অর্থাৎ তিনি জেলে থাকা অবস্থায় যদি আইনি লড়াই বা অন্য কোনও প্রয়োজনে টাকার প্রয়োজন হয়ে তবে তা ধৃত মুকুল বা শেখ শাহজাহান বা বনগাঁর তৃণমূলী নেতা শঙ্কর আঢ্য ওরফে ডাকুকে জানালে তারাই দিয়ে দেবে। তদন্তকারী সংস্থার দাবি, রেশন দুর্নীতিতে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের টাকার ভাগ শেখ শাহজাহান, শঙ্কর আঢ্যের কাছেও রাখা আছে। সেটাই কৌশলে চিঠিতে মেয়েকে জানিয়েছিলেন বালু মল্লিক। তার তথ্য প্রমাণ হিসাবে ইডি আদালতে জানিয়েছে, জ্যোতিপ্রিয়র চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট শান্তনু ভট্টাচার্যর ডায়মন্ড হেরিটেজের দপ্তরে তল্লাশি চালিয়ে এই সংক্রান্ত ডিজিটাল ডেটা উদ্ধার হয়। তাতে বিস্তারিতভাবে এই লেনদেনের তথ্য উল্লেখ করা ছিল। সেই টাকার পরিমাণ কত, তা যদিও এখনও জানা যায়নি। তবে এই চিঠিকে ভিত্তি করেই গত জানুয়ারি মাসে সন্দেশখালিতে শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়েছিল ইডি। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সঙ্গে শেখ শাহজাহানের ঘনিষ্ঠতার ছবিও স্পষ্ট হয়েছে চিঠিতে। জ্যোতিপ্রিয়র কন্যা প্রিয়দর্শিনী প্রকাশ্যেই এর আগে শেখ শাহজাহানকে সমাজসেবী আখ্যা দিয়েছিলেন।

অর্থাৎ খাদ্য মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মাধ্যমেই রেশন চাল, আটায় দুর্নীতি, ভুয়ো কৃষক দেখিয়ে সহায়ক মূল্য লুটের এই চক্র তৈরি হয়েছিল একদিকে বাকিবুর রহমান, বারিক বিশ্বাস, আনিসুর রহমান ওরফে বিদেশ ও তাঁর ভাই মুকুল, অন্যদিকে সেই টাকা পাচার ও রক্ষার দায়িত্বে শেখ শাহজাহান, শঙ্কর আঢ্যরা।  

Comments :0

Login to leave a comment