PROBANDHAYA – KLAYAN DAS | RATH – MUKTADHARA | WEDNESDAY 17 JULY 2024

প্রবন্ধ – কল্যান দাস | রথযাত্রার প্রস্তুতি / লিলুয়া উৎকল সমাজ – মুক্তধারা | বুধবার ১৭ জুলাই ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

PROBANDHAYA  KLAYAN DAS  RATH  MUKTADHARA  WEDNESDAY 17 JULY 2024

প্রবন্ধ

রথযাত্রার প্রস্তুতি – লিলুয়া উৎকল সমাজ

কল্যান দাস

মুক্তধারা


‘লিলুয়া উৎকল রাধাগোবিন্দ সমিতি’-র প্রতিষ্ঠা ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে ১০৩ বৎসর পূর্বে। লিলুয়ায় ওড়িশাবাসীদের অভিবাসন আরও পুরানো। স্থানীয় কল-কারখানা, বিশেষত রোলিং মিল, লোহা-ঢালাই শিল্পের কায়িক শ্রমিক হিসাবে, ওই সব শিল্পের ঠিকাদারদের হাত ধরে এরা লিলুয়ায় আসে। ঠিকাদারদের ব্যবস্থাপনায় লিলুয়ার বিভিন্ন স্থানে এরা একবাড়িতে গোষ্ঠিবদ্ধে ভাবে থাকত। এই বাড়িগুলি ওড়িয়া বাড়ি নামে পরিচিতি পেত। 
‘লিলুয়া উৎকল রাধাগোবিন্দ সমিতি’-র বর্তমান মন্দিরটি এমনই এক ওড়িয়া বাড়ি, পদ্মঘোষ বাগান, লিলুয়া সেন্টাল লাইব্রেরির সন্নিকটে। ওড়িয়ারা প্রথাগতভাবে জগন্নাথ অন্ত প্রাণ এবং সংস্কৃতিচর্চা প্রবণ। সারাদিনের কঠিন পরিশ্রমের পরে তারা জগন্নাথ ভজন-কীর্তনে লিপ্ত হতেন। এইভাবে ওই বসতির স্বল্প পরিসরে, আনুমানিক আড়াই তিন কাঠা,  খুবই সাধারণভাবে সূচনা হয় জগন্নাথ মন্দির। 
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উদ্যোগী ওড়িয়াদের একাংশ নিজ নিজ আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রথম সারিতে উন্নীত হয়ে এমনকি শিল্প-কারখানারও মালিক হন। এদের নেতৃত্বে রাধাগোবিন্দ মন্দির সংস্কার ঘটে এবং এটা লিলুয়ার ওড়িশাবাসীদের ধর্মাচারণের কেন্দ্রে পরিণত হয়। বর্তমানে এই মন্দিরের সম্পাদক ভগীরথী সাহু, তিনিও একজন সম্পন্ন শিল্পোদ্যগী। 
শ্বেত পাথরে সুসজ্জিত জগন্নাথ মন্দির, এছাড়াও নাট মন্দিরের নির্মাণ চলছে। জগন্নাথ মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে বামন অবতার কল্কি, নৃসিংহ এবং হয়-গ্রীবের মূর্তি। মন্দির চত্ত্বরে রয়েছে লক্ষ্মী, বাসনআড়া, বিমলা মা, গণেশ মন্দির এবং তুলসি মঞ্চ। জগন্নাথ মন্দিরের সম্মুখে মন্দিরমুখী গড়ুর স্তম্ভ, ওড়িশা রীতির দু’টি সিংহমূর্তি। পৃথক রসুই ঘর। বর্তমানে মন্দিরের পুরোহিত শশীকান্ত পাণ্ডা সহ একাধিক ব্রাহ্মণ, এরা পুরি থেকে আসেন। এখন জগন্নাথে অঙ্গ পরিমার্জন চলছে, রীতি অনুসারে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে আছেন। গত পাঁচ বছর যাবত তার অঙ্গ পরিমার্জন করছেন স্বপন মান্না, তিনি জগদীশপুর নিবাসী। এটা তার পেশা, তিনি কলকাতার বিভিন্ন মন্দির ও গৃহস্থ বাড়ির দেবমূর্তির পরিমার্জন করেন।
২০১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে মহাসমারহে রথযাত্রা সম্পন্ন হচ্ছে। পূর্বে একটা ছোট লোহার রথ ছিল। এবৎসরে নব-নির্মিত কাঠের রথে রথযাত্রা হবে। পুরী থেকে আসা মূখ্য-কারিগর ভগবান মহারাণার নেতৃত্বে ১২ জন কারিগর রথ নির্মাণ করছেন। রথটি একতলা, উচ্চতায় ১৬ ফুট, বেস ১২×১২ ফুট, ছয়টি বড় চাকা, এবং রথ থামানোর জন্য যান্ত্রিক ব্রেক ব্যবস্থা সম্পন্ন। রথে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা মূর্তি ছাড়াও থাকবে সুদর্শন। এছাড়াও থাকবে জয়া-বিজয়া, দশ-অবতার,ইন্দ্র, ব্রহ্মা, সারথি সহ একজোড়া ঘোড়া। সবগুলিই দারু মূর্তি। রথের সজ্জায় ওড়িশা সংস্কৃতির চিহ্ন-চর্চা। রথের গায়ে আল্পনা, কাঠ খোদাই চিত্র। রথের চূড়ার শীর্ষে ‘কলসী অমলা বেড়া’ এবং ১৪ ‘নাহাকা’, পাখা বিস্তার-করা পায়রা।  মন্দির সম্মুখস্থ লিলুয়া সেন্টাল লাইব্রেরি থেকে রথটি টানা শুরু হয় এবং দুই কিমি পথ অতিক্রম করে পুটুয়াপাড়ায় রেল লাইনের ধারে শিবমন্দিরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গন পর্যন্ত। শিব মন্দিরে জগন্নাথ ৯ দিন অবস্থানের পর ফিরতি যাত্রায় আবার মন্দিরে ফেরেন। এই ৯দিন সেখানে মেলা বসে, প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। ওড়িশার সরকারী সংস্কৃতি দপ্তর থেকে সাংস্কৃতিক দল এসে অনুষ্ঠান করে। এছাড়াও ভজন-কীর্তন-ধর্মগ্রন্থপাঠ চলতে থাকে। এ নয় দিনে নানা ধরণের ভোগ-প্রসাদ হয়। অন্ন ভোগ, মহা প্রসাদ, মিস্টান্ন ভোগ, ৫৬ ভোগ, রসগোল্লা ভোগ ইত্যাদি, প্রতিদিন প্রাতে শীতল ভোগ, সন্ধ্যা আরতি এবং ফলভোগ। জগন্নাথ সহ অন্যান্য মূর্তির প্রতিদিন বেশ পরিবর্তন হয়। 
পুরির জগন্নাথ মন্দিরের প্রথাগুলির অনুরূপ এই রথযাত্রা। পুরির গজপতি রাজার মত এখানেও একজন রাজা আছেন। গত তিন বছর যাবত সন্তোষ কুমার টিকমণি এই রাজার দায়িত্ব পালন করছেন। সাধারণত একজন প্রবীণ ধর্মপ্রাণ, শাকাহারি, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণকে  রাজার দায়িত্বে আমন্ত্রণ করা হয়। শ্রী টিকমণি ৭১ বছরের প্রবীণ, সমাজ সেবী, দানশীল, ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি।   মন্দিরের পক্ষ থেকে তাঁকে গতকাল  ফুল, ফল, মিষ্টি সহযোগে তাঁর বাড়ি গিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তিনি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। রাজা রথযাত্রার অনুমতি দিয়ে সূচনা করেন, প্রথমে ঝাঁটা দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করেন। রথটানায় প্রায় ১২০০-১৫০০ মানুষ অংশগ্রহণ করে, ওড়িশার এপ্লিকের কাজ করা রঙিন ছাতা, ঘোড়া-হাতির প্রতিরূপ সহ লোকনৃত্য, খোল-মৃদঙ্গ সহ  কীর্তন রথযাত্রার আলঙ্কারিক দিক। 
রথ নির্মাণের কাজ শেষ করার জন্য দিনরাত্রি পরিশ্রম করছেন কারিগরগণ।  রথ পরীক্ষামূলক টানায় সফল হয়েছে।  
লিলুয়ার সামগ্রিক জনবসতি প্রাচীন নয়, তারমধ্যে রেলের তিনটি মৌজা অধিগ্রহণে জনস্থানান্তর হয়েছে বালি-উত্তরপাড়ার দিকে। তাই ঐতিহ্য পরিচিতি পাওয়ার মত মঠ-মন্দির এখানে নেই।
এই রথযাত্রা লিলুয়ার সংস্কৃতির এক অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠছে।

 

Comments :0

Login to leave a comment