MUKTADHARA : STORY : MICHIL : SOURAV DUTTA : 26 AUGHST 2024, MONDAY

মুক্তধারা : গল্প : মিছিল : সৌরভ দত্ত : ২৬ আগস্ট ২০২৪, সোমবার

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA  STORY  MICHIL  SOURAV DUTTA  26 AUGHST 2024 MONDAY

মুক্তধারা : গল্প

মিছিল
সৌরভ দত্ত

প্রথম যখন মিছিল শুরু হল চতুর্দিকে বৃষ্টির ভ্রূকুটি।আস্তে আস্তে মরে গেছে রোদ্দুরের কমলা আভা। মনসা তলায় অশ্বত্থের ছায়া পূর্ব-পশ্চিমে দোদুল্যমান। কাঁচা রাস্তা সেই দূরে সড়কে গিয়ে মিশেছে।সেই সর্পিল রাস্তা দিয়েই হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ছুটে আসছে আদিবাসী ও সংখ্যালঘু কলোনির ছেলেপুলেরা। শান্তিপূর্ণ মিছিল হবে তার আবার অনুমতি। গ্রামের কচিকাঁচাদের হাতে অনেক মহিলা ও পুরুষ এসে হাজির হয়েছে ধর্ষক ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সুবিচার চাইতে। ডানপাশের মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরা ও এসেছে ‌।হিরামণি টুডু ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী। ‘তিলোত্তমা’--র রক্তাভ মুখ ওর আর্ট পেপারে।নিচে কালো কালিতে লেখা–ওই ওয়ান্ট জাস্টিস।স্কুল থেকে বেশ কিছুটা দূরে হিমামণিদের ঘর,শালপলাশের জঙ্গল।সে স্কুলের  বাচ্চা মেয়েদের লাইনটা ঠিক করছে।ফেসবুকের সৌজন্যে বিশ্বের মানুষ জেনে গেছে এই আগস্ট বিপ্লবের কথা।স্কুলের তরফে প্রতিবাদী শিক্ষক মঞ্চের প্রভাত বাবু মাইকে ঘোষণা করছেন–বিকাল সাড়ে চারটেয় মিছিল শুরু হবে।আকাশটা ক্রমশ কালো হচ্ছে। রাস্তা দুপাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে জল‌থই  সবুজ ধানক্ষেত। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এস সি প্যানেলে নাম থাকা ছেলেটাও মিছিলে এসেছে। রাজ্যের সরকার অন্যায়ভাবে কিছুজনকে সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে। অধিকাংশ মানুষেরই এখন সরকারি চাকরি নেই।এসব ঘটনা নাড়া দেন রতন স্যারের মনে। সরকারকে বদলাতে হবে।না হলে না হলে নারী সুরক্ষা বিঘ্নিত হবে।আজকের মিছিল আর.জি করে নারী নির্যাতনের ও নৃশংস হত্যালীলার বিরুদ্ধে ।যদি এই মিছিল নিয়ে ও কম তরজা হয়নি। হিরামণিদের স্কুলের হেডস্যার দিদির দলের লোক।আগে দক্ষিণপন্থী শিক্ষক সেলের চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে সেপদও গেছে।বছর খানেক হল প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসেছেন।তার মধ্যেই ছি!ক্ষা-রত্নের পুরস্কার এর জন্য হুড়োহুড়ি ফেলে দিয়েছেন।ফলত যা হয় এই প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে হেডমাস্টারের আপত্তি।আর.জি করের মতো ঘুঘুর বাসা হয়ে উঠেছে গ্রাম-বাংলার স্কুলগুলো। স্কুলের উন্নয়নের নামে কাটমানি। মিড ডে মিলের অর্থ তছরুপ।নিরক্ষর গরীব মানুষকে ফাঁকা ভাউচারে সইসাবুদ করিয়ে নিয়ে। কোনমতে গোঁজামিলে অডিট পাশ করিয়ে নিলেই হল।যদিও কয়েকজন শিক্ষক এবিষয়ে ঘোরতর প্রতিবাদী।তারা ইতিমধ্যেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হয়েছেন এই ঘুঘুর বাসা ভাঙতে।এর মধ্যে কালিয়াগড়ের গ্রাম প্রধান পাড়ার মাতব্বর ইস্মায়েল আগের দিন রাত্রে স্থানীয় শিক্ষক রতনবাবুকে ডেকে বেশ কড়কে দিয়েছে।ফলত স্কুল চত্বরে বেশ মিছিলকে একটা থমথমে পরিবেশ।মিছিল শুরুর একঘন্টা আগে পরিচালন সমিতির সভাপতি এসে উপস্থিত মিছিলটা ভেস্তে দিতে। ওনার আপত্তি– এস্কুল পড়াশোনার জায়গা।এখানে স্কুলের পোশাক-আইকার্ড ঝুলিয়ে আন্দোলন চলবে না। প্রত্যুত্তরে অঙ্কের স্যার  সন্দীপনবাবু স্পষ্টতই বলেছেন–স্কুল ছুটির পরেই এ মিছিল হবে। এবং স্কুলের পোশাক ছাড়াই হবে।ছেলেমেয়েরাও রাজি তারা এতক্ষণ এরকম একটা সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছিল। সন্দীপন বাবু বলে চলেন–তোমরা বাড়ি থেকে দ্রুত পোশাক পাল্টে মনসা তলায় মাঠে চলে এসো।পারলে তোমাদের অভিভাবকদেরও নিয়ে এসো। সন্দীপন স্যারের একটা কথাই পড়ুয়াদের মধ্যে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে।লাইন বাড়তে বাড়তে হাজরা পুকুরের কাছাকাছি চলে গেছে।টোটোয় মাইক বাঁধা প্রভাত বাবু ঘোষণা করছেন–‘তিলোত্তমার হত্যাকারীদের অবিলম্বে শাস্তি চাই।’মিছিল শুরু হয়েছে–ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র  লাল্টু এসেছে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে। লাল্টুর বাকশক্তি নেই–কিন্তু প্রতিবাদের স্পীহা আছে। মিছিলের লেজটা বহুদূর বিস্তৃত।পায়ে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে–নারায়ণ মুর্মু, জসিম শেখ,রণিতা নস্কররা।শাল-পলাশের জঙ্গল পেরিয়ে মিছিল চলেছে।বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হল। বনবিবির মাজার টপকে মিছিল পৌঁছে গেছে হাঁসদা পাড়ায়। সময়ের সাথে সাথে মিছিলের পূর্ব নির্ধারিত স্লোগান গুলো যেন বদলে যেতে থাকে। প্রতিবাদের উলগুলান হয়ে উঠতে থাকে।হিরামণির মানসপটে বীরসা মুণ্ডার মুখ ভেসে। শকুনের চোখের থেকে ও হিংস্র এ সময়ে একটা দ্রোহ কাল ধরা পড়ছে এ রাষ্ট্রে।জয়নাল বলল–“আরেকটু পা চালিয়ে ভাই…”। প্রচণ্ড বর্ষণে মোমের মতো গলে গলে পড়ছে কচিকাঁচাদের পোস্টার-ফেস্টুনের কাঁচাআলতা।বৃষ্টিতে ভিজে হাতের ছাপ গুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।একটা বড় ক্যানভাস তৈরি করছে যেন। আগেরদিন রাত্রে–ভয় পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল রতনবাবুকে।তিনি স্কুলে আজ আসেননি। কিন্তু মিছিল হচ্ছে শুনে মোটরসাইকেলে হাজির হয়েছেন । সন্দীপন বাবু,  প্রভাতবাবুরা পুরোপুরি ভিজে স্নান। তাদের মোবাইল ও দরকারি কাগজপত্র রক্ষা পায়নি।ভাঙা সাঁকো টপকে গিয়ে মিছিল টাকে ঘুরিয়ে নিচ্ছেন সবাই। পদাতিক সৈন্যের মতো শাসকদের বিরুদ্ধে, অন্যায়কারীদের শাস্তির দাবিতে মিছিল এগোচ্ছে ।প্রতিটা প্রতিবাদী মেয়ে যেন ঝাঁসির রানী—মিছিল থেকে চিৎকার উঠছে–‘ধর্ষকের কালো হাত ভেঙে দিও, গুঁড়িয়ে দাও।উই ওয়ান্ট জাস্টিস –উই ডিম্যান্ড জাস্টিস ধ্বনিতে কল্লোলিত সারা আকাশ। এবড়ো খেবড়ো পথে হাঁটতে সমাজের এইসব শয়তান গুলার জন্য হাতে তীর-ধনুক তুলে নিতে চায় হিরামণি। ধর্ষকদের ক্ষমা নাই। দুটো গ্রাম ঘুরে মিছিল‌ এসে পৌঁছল স্টার্টিং পয়েন্টে । এবার উপস্থিত সকলে হাতে হাত রেখে একতা মানব বন্ধন। সন্দীপন বাবুর নীতিবাক্য ভেসে আসছে–তোমরা সকলে মা-বাবার কথা শুনবে। ভালো করে লেখাপড়া করবে।আর যখন যেখানে অন্যায় দেখবে সম্মিলিতভাবে তার প্রতিবাদ করবে। মিছিল শেষ সবাই বাড়ি ফিরে যায় ।শাসক ঘনিষ্ঠ রামেন্দু সরকার ও তার দলবল লোলুপ দৃষ্টিতে বাইক নিয়ে মনসাতলা থেকে এক চক্কর ঘুরে চলে যায়।

হতভম্ব আকাশ বিদীর্ণ হয়ে পূর্ণিমার ক্ষীণ চাঁদের আলো ফুটছে।ক্লাস ইলেভেনের বন্ধুরা কেউ নেই; হিরামণি একা বাড়ির দিকে ফিরছে । বাঁশবাগান,বনবাদাড়ে ঝিঁঝিঁর ডাক।সে ভাবতে থাকে কিভাবে ডাক্তারি পড়তে আসা নিরীহ মেয়েটাকে ওরা শেষ করে দিল।গতকমাস  আগেই তো রাস্তার ধারের পানা পুকুরে একটা  বেওয়ারিশ ডেডবডি পাওয়া গেল।পরে খোঁজ খবর করে পুলিশ জেনেছিল ওটা রাজমিস্ত্রি রামচরণ সিং এর মেয়ে। কান্নায় ফেটে পড়েছিল ওর পরিবার।হিরামণি সেদিন সামনে থেকে দেখেছিল অত্যাচারিত মেয়েটার শরীরে ভয়ার্ত নৃশংস সেই চিহ্নগুলো। মনের মধ্যে ধিকিধিকি ক্রোধের আগুন জমেছে।তার উপর প্রিয় স্যারেদের ডাকে তিলোত্তমা হত্যার প্রতিবাদে মেঘবৃষ্টি উপেক্ষা করে এই মিছিল।

যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় হিরামণি। চাঁদের মৃদু আলোর ফাঁক দিয়ে দূরে দু তিনটে মাথা দেখা যাচ্ছে। মাথাগুলো এগিয়ে আসছে–তাদের কালো হাতের ছায়াগুলো ক্রমশ বড় হয়ে তার দিকে সরে আসছে–চারিদিকে মাকড়শার জাল–দুঃস্বপ্নের রাত–হিরামণি দৌড়তে চাইছে এক ভারতবর্ষ টপকে ,আরেক ভারতবর্ষে….

Comments :0

Login to leave a comment