STORY — SOURAV DUTTA | ULTORATH — MUKTADHARA | MONDAY 15 JULY 2024

গল্প — সৌরভ দত্ত | উল্টোরথের গল্প — মুক্তধারা | সোমবার ১৫ জুলাই ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

STORY  SOURAV DUTTA  ULTORATH  MUKTADHARA  MONDAY 15 JULY 2024

গল্প

উল্টোরথের গল্প 
সৌরভ দত্ত

মুক্তধারা

 

সেবার বাবাকে প্রশ্ন করেছিলাম–“বাবা,রথ তো সোজাই চলেছে,তুমি যে বললে উল্টোরথ–জগন্নাথ ও বেশ হাত তুলে আছে!” উত্তরে কিছুটা থমকে গিয়ে বাবা‌ বলেছিল উল্টোরথ মানে– জগন্নাথ,বললাম, সুভদ্রা মাসির বাড়ি গিয়েছিল সোজা রথের আর আজ নিজের বাড়ি ফিরে আসবে।” ছেলেবেলায় উল্টোপথের মজাটাই ছিল আলাদা।তখন দশ-কুড়ি পয়সার চল ছিল।উল্টোরথ বললেই একটা বেশ অন্যরকম বৃষ্টি মুখর আবহাওয়া।সোজা রথে আমি প্রায় কোনবারই যাইনি।ঘুরতে যেতাম উল্টো রথে।

ক্লাস নাইনের ক্লাসে‌ বঙ্কিম বাবুর রাধারাণী উপন্যাসের প্রক্ষিপ্ত অংশটা পড়াতে পড়াতে অর্চিষ্মান ফিরে যাচ্ছিলো ছেলেবেলার চোরাকুঠুরিতে। রাধারাণীর‌ মাহেশের রথ দেখতে‌ যাওয়ার চিত্র বৃষ্টিতে সবকিছু পয়মাল হয়ে যাওয়ার গল্পটা ক্লাসের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে‌‌ সে বেশ বিহ্বল হয়ে পড়ে।স্কুলের বাইরে আষাঢ়ের বৃষ্টি‌ নেমেছে।গ্রিল দিয়ে দেখা যায় মাঠে বটগাছের ছায়ায় গরুরা ভিজছে।বেড়ার উপর কয়েকটা নীল অপরাজিতা ফুটে‌ আছে।

স্কুলের ছায়াপথ বেয়ে অর্চিষ্মান ঢুকে‌‌ পড়ে‌ শৈশবের আবেশ ঘন দিনলিপিতে।উল্টোরথের দিন ফটিকদার‌ সাথে রথ দেখতে যাওয়া।তার জন্য তোড়জোড় সুরু সকাল থেকে বাবা দশ টাকা ,বড়ো মামা দুটাকা ,ছোটদিদা ও সেজদিদা মিলিয়ে পাঁচ টাকা।রথে শাল পাতায় দশ পয়সার ঘুগনি‌ বেচবে নেড়ুদা। অর্চির ছোট বোন তুলি বায়না ধরবে–“জ্যেঠু আমায় ঐ তালপাতার সেপাই কিনে দাও না…।”আমার প্রিয় ছাগল বাঁশি, মাটির সালতি, আর পয়সা জমানোর বোকা‌ভাঁড়।এখন যদিও বোকাভাঁড় দুর্লভ, বাচ্চাদের পয়সা জমানোর জন্য পিকি ব্যাঙ্ক এসেছে।

উল্টোরথে কাঁঠালের গন্ধে ম ম করত চারিদিক। অনেক অনেক খেলনা কেনার জন্য লোভ জমত মনে।রঙিন বুদবুদ উঠত চন্দর‌ ঠাকুরের‌‌ রথের মেলায়।অর্চি‌ এক বছর ছোট মামাকে বলে আমাকেও এরকম একটা হুবহু রথ বানিয়ে দাও না।রথের রশি টানতে টানতে বাড়ি থেকে মামার বাড়ি আসব আবার সাতদিন ঠাকুর ঘরে রথ রেখে‌‌ আবার উল্টোরথে নিজেদের বাড়ি ফিরব।ছোটমামা বানিয়ে দিয়ে ছিল ছোট্ট রথ।রথের গায়ে নকশা কাটা। কাঠের চাকা।মাথায় ধ্বজা।ঘন্টা নাড়তে নাড়তে সেই রথ পৌঁছে যাবে বোস পাড়া থেকে বর্গক্ষেত্রী পাড়ায়।এই ছিল রেওয়াজ।তারপর যাব মামুদার সাথে উল্টো রথে।অর্চির বাবা কৃষক‌ সমিতি‌ করত।জীবনে কোনদিন ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে গুরুত্ব দেননি।উল্টোরথের‌ প্রসঙ্গে সেবার অর্চির বাবা বলেছিল–“দেখ আমরা তো প্রত্যেকে ঠাকুর দেখতে যাই দুর্গাপুজোয়,নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে হয়,প্রার্থনার জন্য কেউ চার্চে যান। কিন্তু রথের‌‌ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ।এখানে ঈশ্বর নিজে আসেন আপামর মানুষের কাছে। মানুষের সুখ-দু:খের সাথী হতে।রথের রশিতে টান দেয় সমস্ত ধর্মের মানুষ। উল্টোরথ যেতে যেতে আমাদের তাহেরপুরের মসজিদের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যায়।সবাই মিলিত হয় রথকে কেন্দ্র করে। ও পাড়ার আবদুল্লা,
রোশেনারারা ঘরের দেউড়ি থেকে নেমে এসে রথের রশিতে টান দিতে।রথ হয়ে উঠত সমস্ত সমাজের।”

তালপাতার সেপাই ভেঙে কাঁদতে থাকে তুলি।বৃষ্টি নামে‌ …অর্চির মনে পুরনো সেই দুপুরের ঘ্রাণ ভেসে আসে।এখন সকলে খুব ব্যস্ত। উল্টোরথে বাঁধভাঙা ভিড়। জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। প্রচুর রেস্টুরেন্ট। বিকিকিনির সামগ্রীর দোকান অনেক। কেনাকাটা সেরে ক্রেতারা ব্যস্ত ফোন-পে, গুগল-পে করতে।মেয়ে ছোট্ট পুঁটির বানায় মেটাতে পারে না । প্রচন্ড গরমে অস্বস্তি হয়। রথের রশিতে‌ হাত ছোঁয়াতে পারে না সে। চারিদিকে রিলস বানানোর প্রতিযোগিতা।বিশ্রী মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে।বছর‌ কুড়ি আগের‌‌ রতন রায়ের পাঁচালি গানের সুর কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে!প্রসাদ মান্নার‌ মাটির তৈরী হালতি,টেপা‌ পুতুলের দেখা নেই। কয়েকটা দোকানে মেয়ের জন্য হন্যে হয়ে মাটির খেলনা খোঁজে।পুঁটির‌ কিছুই ওসব পছন্দ নয়।সে আধুনিক ডিজাইনের ডল পুতুলের কিনতে‌ চায়। উল্টোরথের মেলায় মাটির সালতি, তালপাতার সেপাই, ছাগল বাঁশি কে না পেয়ে বেশ হতাশ হয়।মেয়ের হাত ধরে ধীরে পায়ে বাড়ি ফিরতে থাকে। চারিদিকে টো টো গাড়ির দৌরাত্ম্যে রথটাকে কিরকম জৌলুসহীন লাগে।মনে মনে ভাবে এটাই তো ডিজিটাল ইন্ডিয়া। চোখের কোণ চিকচিক করে‌ ওঠে। বুড়ো বটগাছের ফাঁক দিয়ে শেষবেলার রোদ্দুর এসে পড়ে অর্চির চোখে‌ মুখে। ছেলেবেলার প্রশ্নটা মাথায় পাক খায়–“বাবা,রথ তো সোজাই চলেছে তবে যে তুমি যে‌ বললে উল্টোরথ!”

ইত্যবসরে ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ে‌ যায়। উল্টোরথের স্মৃতিমাখা ‘রাধারাণী’ গল্পটা শেষ করতে পারে‌ না‌ অর্চি...

Comments :0

Login to leave a comment