SAVE SCHOOL COOCH BEHAR

শ্রীহীন শিক্ষাঙ্গন-১: ক্লাস নেন নিরুপায় ক্লার্ক, ৪টি শ্রেণির ২টি ক্লাসরুম!

রাজ্য

প্রতীকী ছবি।

জয়ন্ত সাহা: কোচবিহার
জেলা শহর কোচবিহারের টাউন হাইস্কুল। স্কুলের গেটের ওপরে নামের পাশের লেখাটা বলে দিচ্ছে ৭১ বছর আগে গড়ে উঠেছিল স্কুল। সামনে বড় মাঠ। চারদিকে স্কুল ঘর। সবই আছে। নেই শুধু প্রাণ, কারণ—   পড়ুয়া নেই।
দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এই স্কুলে। খাতায় প্রায় ৫০০ জন ছাত্রর নাম লেখানো থাকলেও দৈনিক গড়ে উপস্থিত হয় ৫৫-৬০ জন। প্রধান শিক্ষক লিটন দাসের আফশোস,‘‘পড়ুয়ার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়েও পড়ুয়াদের স্কুলে আনা যাচ্ছে না। একাদশ, দ্বাদশেও নাম মাত্র পড়ুয়া নিয়ে ক্লাস চলছে। শিক্ষকের অভাবেই মার খাচ্ছে স্কুল।’’
মঙ্গলবার এসএফআই’র কর্মীরা টাউন স্কুলে গিয়েছিলেন। কথা বলেছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের অভিযোগ জানিয়েছেন। দিনহাটা উচ্চ বিদ্যালয়েও গিয়ে এসএফআই কর্মীদের অভিজ্ঞতা কী? উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানো হয় এই স্কুলে। পড়ুয়ারা এসএফআই কর্মীদের বলছে,‘‘দাদা, আমাদের স্কুলে ২৫০০-র বেশি ছাত্র। কিন্তু শিক্ষক নেই। আমাদের স্কুলে শিক্ষকের ব্যবস্থা করে দাও।’’ 
এসএফআই কোচবিহার জেলা সভাপতি প্রাঞ্জল মিত্র জানালেন,‘‘আগস্ট মাসের মধ্যে আমরা জেলার সব জুনিয়ার হাইস্কুল মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্কুল এবং মাদ্রাসায় যাবো। স্কুলের পড়ুয়া, শিক্ষক থেকে অভিভাবক সবার সাক্ষর সংগ্রহ করে রাজ্যে শিক্ষার বেহাল দশার পরিবর্তন দাবি করে রাজ্য জুড়ে শিক্ষা বাঁচানোর লড়াইকে তীব্র করবো।’’
‘বাঁচার’ অপেক্ষায় ধুঁকছে শিতলকুচি ব্লকের জুনিয়ার হাইস্কুলগুলি। ব্লকের মহিষচরু জুনিয়ার হাইস্কুলের কথাই ধরা যাক। সরকার পোষিত জুনিয়ার হাইস্কুল। স্থায়ী শিক্ষক নেই একজনও। স্কুলের ৮৩ জন পড়ুয়া স্কুলে ক্লাস করতে আসে একজন অতিথি শিক্ষক আর স্কুলের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মীর ভরসায়। শিতলকুচি ব্লকের এবিটিএ-র নেতা ধজেন বর্মন বলছেন, এই ছবিটা শুধু মহিষচরু জুনিয়ার হাইস্কুলের নয়, ব্লকের সব জুনিয়ার হাইস্কুলের ছবিটা  প্রায় একই রকম। কোথাও স্কুলের শিক্ষকই দরজা, জানালা বন্ধ খোলা, স্কুলের ঘন্টা বাজানোর কাজ করেন। কোথাও শিক্ষকের অভাবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ক্লাস নেন। 
১১ বছর মহিষচরু জুনিয়ার হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। স্কুল হলে কী হবে? শিক্ষক নিয়োগ হয়নি একজনও। অগত্যা ভরসা সেই অতিথি শিক্ষক।
কিন্তু জুনিয়ার হাইস্কুলে তো অতিথি শিক্ষক নিয়োগের কোন অনুমতি নেই। তবুও কি করে বছরের পর বছর অতিথি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস চলছে? অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক মুনমুন রায় আবার এই স্কুলের মেম্বার সেক্রেটারি! তিনি বলছেন,‘‘শিক্ষক চাওয়া হয়েছে। নিয়োগ হলেই ওই স্কুলে শিক্ষক আসবে। সঙ্কট কাটাতে অন্য এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে জুনিয়র হাইস্কুলে পাঠানোর জন্য ডিপিএসসি-র কাছে সুপারিশ করেছি। সুপারিশ অনুমোদিত হলে তিনি আসবেন জুনিয়ার হাইস্কুলে পড়াতে।’’ 
তার মানে প্রাথমিক শিক্ষক পড়াবেন জুনিয়ার হাইস্কুলে! এও সম্ভব? মহিষচরু হাইস্কুলের দুটি রুম। তাতেই বসে ৪ টি ক্লাসের পড়ুয়া। শিক্ষকদের বসার আলাদা ঘর নেই। তাঁরাও ওই ঘরের এক কোণে চেয়ার টেবিল আলমারি দিয়ে অফিস বানিয়েছেন। এভাবেই চলছে ১১ বছর ধরে লেখাপড়া। স্কুলের একমাত্র অতিথি শিক্ষক মোবারক হোসেন বলছেন,‘‘বুঝতেই পারছেন কীভাবে স্কুল চলছে। আমি শুধু চেষ্টা করে যাচ্ছি স্কুলটা যেন উঠে না যায়।’’ প্রায় ৬ বছর আগে স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন উত্তম কুমার দাস। তাঁর কথায়,‘‘স্কুলে এসে দেখি একজন অতিথি শিক্ষক ৪টি ক্লাস সামলাতে পারছেন না। নিজেই পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছি। যতটুকু পারি ওদের পড়াই আবার স্কুলের ক্লার্কের কাজ করি। দুজন মিলে হিমসিম খেয়ে যাই প্রতিদিন।’’
অভিভাবক হেমন্ত বর্মনের গলায় আক্ষেপের সুর,‘‘স্কুল থাকা না থাকা সমান কথা। শিক্ষক ছাড়াই স্কুল। এরকম কেউ কখনও শুনেছে। সেটাই চলছে ২০১৩ সাল থেকে। মিড ডে মিল খাবার জায়গা নেই। স্কুলের বারান্দায় বসে বাচ্চারা মিডডে মিল খায়। পানীয় জলও নেই স্কুলে। এত ‘নেই’য়ের মাঝেও  শিখা রায়, শিবানী বর্মনদের মতো ছাত্রীদের আশা স্কুলে একদিন শিক্ষক আসবে। 
এবিটিএ-র শিতলকুচি ব্লকের নেতা শিক্ষক ধজেন বর্মন বলেন,‘‘ব্লকে ২৮টি জুনিয়ার হাইস্কুল আছে। এরমধ্যে বড় ধাপের চাত্রা ও বাঁশভাঙা জুনিয়ার হাইস্কুলে শিক্ষক সঙ্কট কিছুটা কম। বাকি ২৬টি স্কুলেই শিক্ষক ও পরিকাঠামো সঙ্কট রয়েছে। ২৮টি জুনিয়ার হাইস্কুলের মধ্যে অন্তত ১০টি স্কুলে একজন শিক্ষকও নেই। স্কুল চলছে অতিথি শিক্ষক দিয়ে। 
উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ কমছে প্রতি বছর! গত তিন বছরে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে জেলার ৯টি স্কুলে। এবিটিএ-র জেলা সম্পাদক সুজিত দাস বলেন, বিপুল পরিমাণ শিক্ষক ঘাটতিই এর জন্য দায়ী। শিতলকুচির গোলেনাওহাটি জামে হাই মাদ্রাসা স্কুলে শিক্ষকের অভাবে এবারে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি নেওয়া হয়নি।
কোচবিহার জেলার ৫টি মহকুমায় ৪২টি মাধ্যমিক স্কুল, ২০৮টি উচ্চমাধ্যমিক, ৩০০টি জুনিয়ার হাইস্কুল ও ২৩টি সরকার পোষিত মাদ্রাসা রয়েছে। ৯০% স্কুলেই রয়েছে শিক্ষকের সঙ্কট। আবার জুনিয়ার হাইস্কুলের ক্ষেত্রে শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। এসব যাদের দেখার কথা সেই জেলা শিক্ষা দপ্তর এবং তাদের অধীনে থাকা মহকুমা ও ব্লক শিক্ষা দপ্তরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। 
উদাহরণ মেখলিগঞ্জ মহকুমাসহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক অফিস। সরকারি হিসেব অনুযায়ী কর্মী ও আধিকারিক মিলিয়ে মোট ৯ জন থাকার কথা। এখন একজনও নেই। অফিস চালাচ্ছেন এক অস্থায়ী কর্মী! দীর্ঘদিন ধরেই কর্মী সংকটে ভুগছিল এই অফিস।একজন আধিকারিক এতদিন অফিসটি চালাচ্ছিলেন। তিনিও পদোন্নতির ফলে অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। ভরসা ওই অস্থায়ী কর্মীই। জেলার সব কটি মহকুমার শিক্ষা দপ্তরের অফিসের বেহাল চিত্র।
এসএফআই’র রাজ্য সভাপতি প্রণয় কার্য্যী জানিয়েছেন, গত ১৫ জুন থেকে আমাদের ‘স্কুল বাঁচাও, মূল বাঁচাও’ আন্দোলন আগামী এক বছর ধরে তিন পর্যায়ে চলবে। প্রতিটি জেলায় ছাত্র সমাবেশের মধ্যদিয়ে কর্মসূচীর সমাপ্তি হবে। এর মধ্য দিয়ে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার কংকালসার চেহারা জনসমক্ষে আনা হবে।
 

Comments :0

Login to leave a comment