RAMKINKAR BAIJ 25 MAY 1906

অনন্য রামকিঙ্কর বেইজ

ছোটদের বিভাগ

RAMKINKAR BAIJ 25 MAY 1906

অনন্য রামকিঙ্কর বেইজ

 

ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পে আধুনিকতার জনক রামকিঙ্কর

ঋষিরাজ দাস

আদ্দির কাপড়ের কুর্তা র প্রান্ত গুলো বেরিয়ে আছে। সাদা কোকরা চুল এর উপর ঠাই নিয়েছে কৃষকদের টুপি। আঙুলগুলো কাটিস পেপারের উপর চড়ে বেড়ানোর অপেক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক যখন শান্তিনিকেতনে রামকিঙ্কর বেইজের উপর তথ্যচিত্র বানাতে যান তখন এমনটাই বর্ণনা দিয়েছিলেন তার প্রিয় কিংকর দা কে দেখে।

 

 

রামকিঙ্করের জন্ম ১৯০৬ সালের ২৫শে মে তবে তার জন্ম জন্ম সাল ও জন্মতারিখ নিয়ে অনেক মতভেদ মতান্তরে পঁচিশের বদলে ২৬ শে মে তার জন্মদিন দাবি করেন কেউ কেউ । তবে শান্তিনিকেতন সহ অন্য স্থানে গবেষকরা ২৫ শে মে কেই আধুনিক এই ভাস্কর্য আর এই পথিকৃৎ এর জন্মদিন বলে গণ্য করেন।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার যোগী পাড়া গ্রামে তার জন্ম। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন দিনমজুর। রামকিঙ্করের পিতা চণ্ডীচরণ আর মা সম্পূর্ণা। বাবা পেশায় ছিলেন নাপিত। চার ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ডানপিটে আর পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন রামকিঙ্কর। ছবি তিনি নিজে নিয়েছিলেন। পারিবারিক পদবী ছিল প্রামানিক। তার নাম নিয়ে ব্যাপক ঠাট্টা তামাশার প্রচলন ছিল। এমন কি কবি নিশিকান্ত তার নাম নিয়ে ছড়া কেটে বলেছিলেন-

রামকিঙ্কর প্রামানিক
নামটা বড়ই হারমনিক।
ছোটবেলায় ভাস্কর্যের সঙ্গে তার প্রেম গড়ে উঠেছিল। কার আত্মকথায় তিনি বলেছেন ছোটবেলা থেকেই দেবদেবীর ছবি তার খুব পছন্দের ছিল।  তিনি সেই সব ছবি দেখতে আর কপি করতেন ভিসুয়াল আর্টে তার প্রথম বর্ণপরিচয়। 
ছোটবেলায় তার প্রথম মূর্তি গড়ার ইতিহাসটাও খুব মজার।  বাড়ির সামনে লালমোড়ামের রাস্তা, একদিন দেখলেন বৃষ্টিতে মোরাম ধুয়ে নীল রঙের মাটি বেরিয়ে পড়েছে । চোখে পড়া মাত্রই সেই মাটি খাবলে তুলে নিয়ে নানা রকম পুতুল তৈরি করতে লাগলেন । সুযোগ পেলেই তিনি কুমোড়দের কাছে সময় কাটাতেন এবং মাটিতে হাত লাগিয়ে মাটি ছানাছানি করতেন। প্রতিবেশী অনন্ত সূত্রধর ছিলেন তার প্রথম শিল্প-শিক্ষক। তিনি প্রতিমা করতেন। রামকিঙ্কর তাকে সাহায্য করতেন। কিশোর বয়সের এই শিক্ষক অনন্ত সূত্রধরের কথা রামকিঙ্কর সারা জীবন মনে রেখেছিলেন। রং হিসেবে ব্যবহার করতেন গাছের পাতার রস বাটনা বাটা শীলের হলুদ মেয়েদের পায়ের আলতা ভুষোকালী। পাড়ার প্রতিমা শিল্পীদের দেখে ছাগলের ঘাড়ের লোম কেটে বাশের কাঠির ডগায় বেঁধে তুলি তৈরি করতেন।
বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। এই লেখাপড়া শুরু হয়েছিল অবৈতনিক স্কুলে। স্কুলের দেওয়ালে ছবি আঁকা আর পত্রিকায় ছবি দেওয়া ছিল তার প্রতি মাসের কাজ। স্বদেশী মেলায় জাতীয় কংগ্রেসের পোস্টারে কেউ তিনি হাত পাকিয়েছিলেন।

 

 

লেখাপড়ায় মন ছিল না তাই কোন মতে ম্যাট্রিক পাস করে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যস্থতায় শান্তিনিকেতনে পা রাখেন। ভর্তি হলেন কলাভবনে। শিক্ষক হিসেবে পেলেন নন্দলাল বসু এবং গুরু হিসেবে পেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ১৯৩০শে যোগ দিলেন কলাভবনে। ১৯৩৪ সালে স্থায়ী শিক্ষক। ১৯৪০ এ ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান। ১৯৭১ এ তিনি অবসর গ্রহণ করেন । তার ছাত্র জহর দাশগুপ্ত শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের বিশিষ্ট শিল্পী।
নন্দলাল বসু বলেছিলেন 'তুমি সবই জানো তবে এখানে কেন?' কলাভবনে তিনি তেল রংয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। লাল বসু প্রথমে আপত্তি করলেও পরে মেনে নিয়েছিলেন। একারণেই রামকিঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষের শিল্প ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বশিক্ষিত একজন শিল্পী। তার বিখ্যাত দুটি শিল্পকর্ম হলো সাঁওতাল পরিবার এবং কলের বাঁশি। সাঁওতাল পরিবার তৈরি হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। এর বাঁশি ১৯৫৬।
এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল কচ ও দেবযানি, রিলিফ সাঁওতাল, কৃষ্ণ গোপিনী, সুজাতা। ১৯৩৭ সাল থেকে তিনি ছাত্রদের মডেলিং শেখানোর দায়িত্ব নেন। ওই সময় থেকেই তিনি তেল রঙে কাজ শুরু করেন। প্লাস্টারে পড়তে সময়ে রবীন্দ্রনাথ , হেড অফ এ ওমেন , বাতিদান প্রভৃতি ভাস্কর্য তৈরি করেন।
১৯৭০ সালে তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত হন। ১৯৭৫এ আনন্দবাজার পত্রিকা তাকে সম্মানিত করে। এছাড়াও সাহিত্য একাডেমীর ফ্যালো দেশিকোত্তম এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট সম্মানের সম্মানিত হয়েছিলেন।

 

 

 

রামকিঙ্কর তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজের পোর্ট্রেট দেখে তাকে বলেছিলেন যখন যা দেখবে বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরে দেখবে। পিছন দিকে তাকাবে না। ঋত্বিক ঘটক রামকিঙ্করকে নিয়ে তথ্যচিত্রের কাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুতে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
১৯৮০ সালে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বিভিন্ন শিল্পী সংগঠনের পক্ষ থেকে এবং তৎকালীন রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহায়তায় এসএসকেএম হাসপাতালে তার চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু চিকিৎসকদের চেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৮০ সালের দোসরা আগস্ট রাত বারোটায় তিনি প্রয়াত হন। শান্তিনিকেতন ত্যাগ করার সময় তিনি বলেছিলেন আর ফিরবো না। সে কথাই সত্যি হলো। কলকাতাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় এই ভাস্কর।
তার জন্ম দিবসে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।

ঋষিরাজ দাস
ষষ্ঠ শ্রেণী 
কল্যাণ নগর বিদ্যাপীঠ
খড়দহ উত্তর ২৪ পরগনা
কল্যাণ নগর, খড়দহ
৮৫৮২৮৩৫৬৫৩

 

Comments :0

Login to leave a comment