MUKTADHARA GOLPO BABU KAR

মুক্তধারা গল্প

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA GOLPO BABU KAR 29 MAY

লকডাউন

বাবু কর

একটা চালের দানাও নেই ঘরেতে...
শুয়ে আছি ঘরের মেঝেয় আর থেকে থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি তিন বছরের ছেলেটার, গা টা রিরি করে উঠছে... বড্ড অবাধ্য। একটু থাম না, তোর চারপাশে দেখতো কত ছেলেমেয়ে না খেয়ে আছে, ওরা কি তোর মতন অমন চিৎকার করে কাঁদে? বুঝিস না! এইসময় খিদের জ্বালায় এমন করে কাঁদতে নেই। সবাই শুনতে পাবে যে...। একটু সহ্য করতে শেখ, বাবার কষ্টটা বোঝ! এটাই তো শেখার সময়। যেমন আরও ছোটবেলায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে চাঁদ ধরা শিখেছিলিস। ঠিক, সেইভাবে খিদেকে জয় করতে শেখ বাবা...
আমার চাকরিটা করোনায় আক্রান্ত।

মালিক জানিয়েছে, কোনও অর্ডার নেই, পৃথিবীর ভয়ঙ্কর অসুখ, মহামারী... তাই কারখানা বন্ধ যতদিন না অসুখ সারছে। 
বউটা আবার পোয়াতি। ভাবছে, করোনা আজ হোক বা কাল হোক থেমে যাবে, এ তো চিরকালের নয়। 
সবাই যে যার মতো করে ভাবছে! 
লকডাউন চলছে... বাইরে বেরোতে পারছি না। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তা একদম শুনশান... একদল পুলিশ হেঁটে চলে গেল।  গত সাতদিন আগে কয়েকজন ছেলে এসে দু’কেজি চাল আর কিছু ডাল আলু দিয়ে গিয়েছিল। আর কেউ আসেনি। ওরা কি আবার কিছু দিতে আসবে ! 
ছিঃ, নিজেকে কেমন ভিখিরি মনে হচ্ছে।  
আচ্ছা! অমল বিজন ওরা কেমন আছে! বিজনের বাবাতো খুবই অসুস্থ। শুনেছি মাসে অনেক টাকার ওষুধ লাগে! কি করছে ও! অমল একা। যাহোক করে ও হয়ত চালিয়ে নেবে, কিন্তু বিজন! বাবা মা বউ ছেলে! ও কি করছে! দু’দিন আগে ফোন করেছিল, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কথা বলছিল!  একটা মার্কেটিং কোম্পানির এজেন্ট। ওর মার্কেটিং কোম্পানিও লকডাউনের শিকার, কিছু জমানো টাকা হয়ত এখনও ওর আছে, তাই বা কদিন! এতদিন তো ফান্টুসবাবু ছিল, এখন তো আমার মতন ভিখিরিও হতে পারবে না। কি করবে মধ্যবিত্তের তকমা আঁটা বিজন! 
ওর জন্যে ভীষণ ভয় হচ্ছে...
হ্যাঁ, একদিন করোনা হয়ত থেমে যাবে, কিন্তু,থামবে কি খিদের যন্ত্রণা! খিদের মহামারী হয়ত গোটা পৃথিবীকে গিলে খাবে। কোটি কোটি মানুষ তার চাকরি খোয়াবে। কি হবে তখন! 

আকাশটা এখন যেমন আছে, হয়ত তখন তেমনই থাকবে। তারাদের মেলা বসবে, পাখিরা গাছে গাছে শিস দেবে, কেউ কেউ হয়ত আবার চাঁদ সূর্য আকাশ নিয়ে গান কবিতা লিখবে। 
আর এদিকে আমার ঘরে ছোট্ট ছেলেটা যখন মাঝে মাঝে খিদের জ্বালায় কঁকিয়ে উঠবে তখন কি অসহায় হয়ে পাশ ফিরে বিছানায় ঘুমের ভান করে পড়ে থাকবো নাকি শিলিং এর ফ্যানটায় নিজেকে ঝুলিয়ে দেব...! ছিঃ এসব কি ভাবছি আমি! তাহলে  কিছু একটা করতে হবে তো...!  কার কাছে যাব! কে দেবে আমায় কাজ!  
আর কয়েকমাস বাদে আমার ঘরে আবার নতুন অতিথি আসছে... এসময় কি দরকার ছিল তার আসার! আসার আর সময় পেল না!
হায় ঈশ্বর! আমাকে বলে দাও আমি কি করব? 
আমার মালিককে গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার ফোন করেছি, ফোন ধরেনি... 
অথচ এইসময় দেশের প্রধানমন্ত্রী ছাঁটাই করতে বারণ করেছেন, মাইনে দিতে বলেছেন। বড় আশায় ছিলাম... মাইনেটা হয়ত পেয়ে যাব। যে ফোনই ধরছে না, সে কি কখনও আর মাইনে দেয়...! 

কেন্দ্রীয় সরকার একবছর ডিএ দেবে না ঘোষণা করেছে। রাজ্য সরকার রেশনে বিনিপয়সায় গরিবদের একসাথে একমাসের রেশন দিতে বলেছে শুনে গত তিনদিন আগে গিয়েছিলাম রেশন দোকানে।  টিভিতে বারবার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করছেন। গিয়ে শুনলাম ওয়ার্ড অফিস থেকে স্লিপ নিয়ে আসলে তবে বিনিপয়সায় রেশন পাবো। মানে কাউন্সিলরের কাছে যেতে হবে।‌ ফিরে এলাম। গেলাম কাউন্সিলরের কাছে, একদিন গেলাম, দু’দিন গেলাম... পেলাম না, ব্যস্ত মানুষ তো...! আর যাইনি। 
ডাক্তার বলেছে, এইসময় তোমার বউটাকে একটু মাছ মাংস দুধ ফল খাওয়ালে শরীরটা ভালো থাকবে। 
আমার বউটা না সত্যিই খুব ভালো, সরল সাদাসিধে। আমার অবস্থা খানিকটা বুঝে চুপ করে গেছে। শুধু বলছে, কিচ্ছু ভেবো না, লকডাউন শেষ হলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। 
আমি একটু হাসি... 
ভাবি, তোমার কথাই যেন ঠিক হয়...।

 

 

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment