Anubrata Mondal

সব চেষ্টা ব্যর্থ, অবশেষে তিহারেই অনুব্রত

রাজ্য

অবশেষে তিহার জেলেই তৃণমূলের বীরভূম জেলার সভাপতি, মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহের কেষ্ট ওরফে অনুব্রত মণ্ডল। গত প্রায় সাত মাস ধরে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে কপিল সিবাল থেকে অভিষেক মনু সিংভির মতো আইনজীবীদের দাঁড় করিয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি হাইকোর্ট, একের পর এক মামলা রুজু করে, কখনও তৃণমূল কর্মীকে দিয়েই মিথ্যা মামলা রুজু করে অনুব্রত মণ্ডলের তিহার যাত্রা ঠেকানোর মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল শাসক তৃণমূল মায় মমতা ব্যানার্জির প্রশাসন। সব কিছুই বিফলে গেল। মঙ্গলবার বিকালে শেষ পর্যন্ত তিহার জেলেই যেতে হলো গোরু পাচারে অভিযুক্ত এই দাপুটে তৃণমূল নেতাকে। 
আর তিহার জেলে অনুব্রত ঢুকতেই বদলে গেল তাঁরই দলের ভাষ্য! গত ১৪ আগস্ট বেহালায় স্বাধনীতা দিবস উদ্‌যাপনের সভা থেকেই মুখ্যমন্ত্রী অনুব্রতকে ‘বীর’ সম্বোধন করে তাঁকে বীরের মতোই ছাড়িয়ে আনার কথা বলেন। তাঁরই সুর ধরে খাস বীরভূমে গিয়ে ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, ‘অনুব্রত মণ্ডল খাঁচায় বন্দি বাঘ’! অথচ অনুব্রত মণ্ডল তিহার জেলে পা রাখতেই দলের মুখপাত্র হিসাবে এদিন সাংবাদিক বৈঠকেই মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘কেউ পদে থেকে যদি দুর্নীতি  করেন তার দায় পার্টির নয়। একজন মন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়েছিল দল, জেলা সভাপতি তো ছোট ব্যাপার।’ পার্থ চ্যাটার্জি মন্ত্রী ছিলেন, তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। শশী পাঁজার মন্তব্যে স্পষ্ট জেলা সভাপতি ছোট ব্যাপার। পার্থ চ্যাটার্জির পদমর্যাদা অনেক বড় ছিল!
প্রথম দফায় তিনদিন ও দ্বিতীয় দফায় ১১দিন দিল্লিতে ইডি হেপাজতে থাকার পরে মঙ্গলবার রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে পেশ করা হয় অনুব্রত মণ্ডলকে। এদিন দুপুরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরে অনুব্রত মণ্ডল সঙ্গে চারটি ব্যাগ নিয়ে আদালতে আসেন। আদালতে জানান ব্যাগে তার মাস্ক, নেবুলাইজার সহ ওষুধপত্র রয়েছে, এসব দেখেই যেন বিচারক সিদ্ধান্ত নেন। অনুব্রত মণ্ডলের তরফে আইনজীবীরা যদিও জামিনের আবেদন জানাননি। ইডি’র তরফে জেল হেপাজতে পাঠানোর আবেদন জানানো হয়। বিচারক কেবলমাত্র অনুব্রত মণ্ডলের কবে জন্ম তা জানতে চান। শুনানির পরেই বিচারক ১৩দিনের জেল হেপাজতের নির্দেশ দেন। তিহার জেলেই গোরু পাচারকাণ্ডে বন্দি থাকা হিসাবরক্ষক মনীশ কোঠারির সঙ্গেই আগামী ৩ এপ্রিল অনুব্রতকে ফের আদালতে পেশ করতে হবে। ইডি’র তরফে আদালতে জানানো হয় তিহার জেলের ভিতরেই অনুব্রত মণ্ডলের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
গোরু পাচারকাণ্ডে এর আগে তিহার জেলেই বন্দি ছিলেন বিএসএফ কমান্ড্যান্ট সতীশ কুমার। গোরু পাচার মামলায় সতীশ কুমারই প্রথম গ্রেপ্তার হয়। এরপরে গোরু পাচারের কিংপিন এনামুল হকও তিহার জেলেই ছিলেন। তারপর অনুব্রতর দেহরক্ষী সায়গল হোসেন, হিসাবরক্ষক মনীশ কোঠারি এবং সবশেষে অনুব্রত মণ্ডলের ঠিকানা হলো তিহার জেল। 
গোরু পাচারকারীদের জন্য ব্যাকডেটেড জাল রসিদ তৈরি করা থেকে শুরু করে ইলামবাজার থেকে মুর্শিদাবাদের ৮টি থানা এলাকা হয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে গোরু পাচারের রাস্তা মসৃণ করা শুধু নয় পাচারের কোটি কোটি টাকা বাড়ির কাজের লোকেদের অ্যাকাউন্ট খুলিয়েও সাদা করা হত। এর আগের শুনানিতে রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে ইডি জানিয়েছিল, গোরু পাচারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একাধিক নথি পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশে লোক মারফত সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অনুব্রত মণ্ডল, তাঁর মেয়ে ও ঘনিষ্ঠ চারজন ঘনিষ্ঠের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৬কোটি ৯৭লক্ষ টাকার হদিশ মিলেছে। যদিও ২০১৪ থেকে ১৯’ পর্যন্ত ছয় বছরে গোরু পাচারের বিপুল টাকার কারবারের একেবারে ক্ষুদ্রতম অংশ এই ১৭ কোটি। দিল্লিতে, উত্তরপ্রদেশে ফ্ল্যাট, জমিরও হদিশ মিলেছে। গোরু পাচারের কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করেছে অনুব্রত মণ্ডল।
গোরু পাচারকাণ্ডে নয় বার সিবিআই-র জেরার এড়ানোর পরে গত ১১ আগস্ট সকালে বোলপুরের নীচুপট্টিতে তাঁর বাড়ি থেকেই অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। এরপর দু’দফায় ১৪দিনের সিবিআই হেপাজতের পর থেকে গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে জেলবন্দি এই তৃণমূল নেতা। এরপর গত ১৭ নভেম্বর আসানসোল জেলে থাকা অবস্থাতেই অনুব্রত মণ্ডলকে ‘অ্যারেস্ট’ করে ইডি। ১৮ নভেম্বর  দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে অনুব্রতর বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারির আবেদন জানায় ইডি। একমাস পরে  ১৯ ডিসেম্বর সেই আবেদন মঞ্জুর হয়। পালটা দিল্লি হাইকোর্টে যায় অনুব্রত মণ্ডল। কপিল সিবাল, মুকুল রোহতগীদের মতো আইনজীবীদের বিপুল টাকা খরচ করে নামানো হয় এই মামলায়। এক রাতের মধ্যে তৃণমূল কর্মীকে দিয়েই মিথ্যা মামলাও রুজু করা হয়। 
শেষমেশ চলতি মাসের প্রথমেই রাউস অ্যাভিনিউ কোর্ট প্রশ্ন তোলে, অনুব্রত মণ্ডলের প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হলেও তা কার্যকর করা হয়নি কেন। তারপরেই  দিল্লিতে হাজির করার জন্য সমন জারি করা হয়। তা নিয়েও চলে দোলাচল। ফের কলকাতাই হাইকোর্টে ও দিল্লি হাইকোর্টে যায়, দু’জায়গা থেকেই আবেদন খারিজ হয়। আদালতের নির্দশের পরেও পুলিশ প্রশাসনের গড়িমসি, শেষমেশ দোল উৎসবের দিন দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয় এই দাপুটে তৃণমূল নেতাকে।
এদিকে, গোরু পাচারকাণ্ডে অনুব্রত কন্যা সুকন্যা মণ্ডল সহ তাঁর ঘনিষ্ঠদের তলবের পাশাপাশি এবার ফের আইন মন্ত্রী মলয় ঘটককে তলব করল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। দিল্লিতে ইডি’র সদর দপ্তরেই জেরায় তলব করা হয়েছে মলয় ঘটককে। তবে গোরু পাচার নয়, কয়লা পাচারকাণ্ডেই মলয় ঘটককে তলব করা হয়েছে। এর আগে একাধিকবার জেরা এড়িয়েছেন আইন মন্ত্রী। আগামী ২৯ মার্চ তাঁকে দিল্লিতে তলব করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাঁর আপ্ত সহায়ককেও তলব করা হয়েছে এই কয়লা পাচারকাণ্ডেই। 
এর আগে পরপর ৮বার কয়লা পাচারকাণ্ডে তলবের নোটিস পেয়েও জেরা এড়িয়েছেন রাজ্যের আইন মন্ত্রী। ২৯ মার্চ যদি ফের জেরা এড়ান মলয় ঘটক তবে এবার কঠোর পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিতে চলেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর সিবিআই আসানসোল ও কলকাতায় মলয় ঘটকের সাতটি ঠিকানায় তল্লাশি চালায়। আসানসোলের তিনটি বাড়ি থেকে বেশ কিছু কাগজপত্র, নথি, ব্যাঙ্কের লেনদেনের কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। মন্ত্রীর তিনটি স্মার্টফোনও বাজেয়াপ্ত করেছিলেন সিবিআই আধিকারিকরা।
 

Comments :0

Login to leave a comment