Job Scam GTA

পাহাড়েও শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বেনজির ছবি!

রাজ্য

পাহাড়ে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এফআইআর রুজু করলো খোদ রাজ্য সরকার! নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে এই প্রথম কোনও অভিযোগ করল রাজ্য সরকার। আর সেই এফআইআরে অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন খোদ প্রাক্তন মন্ত্রী যিনি এখনও তৃণমূলী বিধায়ক, সেই পার্থ চ্যাটার্জি, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য ও পাহাড়ের প্রাক্তন তৃণমূলী নেতা ও জিটিএ’র নির্বাচিত সদস্য বিনয় তামাঙ সহ মোট ৮ জন!
কিন্তু এমন এমন উলটপূরাণ কেন? রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দপ্তর কেবলমাত্র কি আদালতের ভর্ৎসনার মুখে এমন এফআইআর করল? আদালতের ভর্ৎসনার পরেই বিধাননগর উত্তর থানা তাই কি তড়িঘড়ি সেই অভিযোগকে এদিন এফআইআর হিসাবে গ্রহণ করল? ঘটনা পরম্পরা এবং পাহাড়ে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির যে চেহারা সামনে এসেছে তাতে আস্ত মন্ত্রীসভা এবং মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাও সামনে চলে আসছে। মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা ক্যাবিনেটের মিটিংয়ের সিদ্ধান্তই সেই দুর্নীতির দরজা খুলে দিয়েছিল। সরকার, প্রশাসন তাই এখন ইতিমধ্যেই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে সিবিআই-র হাতে ধৃত জেলবন্দি পার্থ চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে এফআইআর রুজু করে কী মাথাকে আড়ালেরই চেষ্টা চালাচ্ছে, এই প্রশ্ন জোরালোভাবেই উঠে আসছে।
তবে কেন্দ্রীয় এজেন্সি নয় এবার রাজ্য সরকারের পুলিশই শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে এফআইআর করতে বাধ্য হলো! তবে এই বিষয়ে আর একটা প্রশ্নও উঠছে তা হলো, কেন্দ্রীয় এজেন্সি এই নিয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ যাতে না পায়, সেই জন্যই কি তার আগেই তড়িঘড়ি রাজ্য পুলিশ ব্যবস্থা নিল! কেন্দ্রীয় এজেন্সি এদের হাতে নিলে দুর্নীতির মাথাদের বিপদ বাড়তে পারে বুঝেই কি এই এফআইআর?
পাহাড়ে নিয়োগ দুর্নীতির ছবিটা কেমন? উদাহরণ - শহীদ নবীন তামাঙ প্রাইমারি স্কুল, কার্শিয়াঙের রোহিনীতে। স্কুল চত্বর জুড়ে ছবির মতো সাজানো প্রাকৃতিক দৃশ্য। পাহাড়ের এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট ছাত্র আছে মাত্র ২ জন। আর শিক্ষক কতজন? মোট ৮ জন। তার মধ্যে ৩ জন স্থায়ী, ৫ জন ‘স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক’(ভলান্টিয়ার টিচার)। অর্থাৎ ছাত্র সংখ্যার ৪ গুন শিক্ষক!
লঙভিউ চা বাগানের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০২২ শিক্ষাবর্ষে কোনও ছাত্রই ছিল না। স্কুলে ছাত্র নেই অথচ শিক্ষক সংখ্যা ৬। এই ৬ জনই ‘স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক’! লঙভিউ বাগানের শ্রমিকদের কথায়, ‘ভলান্টিয়ার টিচার’ পাহাড় জুড়ে নিয়োগ হচ্ছে কেন সেটা খোঁজ নিয়ে দেখুন, এখানেই বিস্তর দুর্নীতি’।
সমতলে যখন প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী  নিয়োগ দুর্নীতির পাশাপাশি, মমতার ব্যানার্জির দাবি মতো হাসতে থাকা পাহাড়েও শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে মারাত্মক দুর্নীতির ছবি। মূলত স্বেচ্ছ্বাসেবক শিক্ষকদের কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই স্থায়ী হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে। সরাসরি জিটিএ’র মদত আছে যেমন তেমনি পাহাড়েও শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে সামনে এসেছে সেই তৃণমূলেরই ভূমিকা। টাকার বিনিময়েই চলেছে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া। পাহাড়ে দায়িত্বে থাকা শাসক তৃণমূলের কলকাতার এক বড় নেতা, মন্ত্রী সরাসরি টাকা তুলেছিলেন এই নিয়োগের মাধ্যমে। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সেই নেতাকে সন্তর্পনে বাদ রাখা হয়েছে এফআইআর-এর তালিকা থেকে। 
জিটিএ’র অধীনে থাকা প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কোনও নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা ছাড়াই প্রায় ১০০০ জনের কাছাকাছি শিক্ষককে পাহাড়ের বিভিন্ন স্কুলে নিয়োগ করা হয়েছে। এই বিষয়ে তদন্তের আরজি জানিয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে। সেই মামলায় নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে বিচারপতি এবং আইনজীবীদের হাতে একটি চিঠি এসেছিল। জিটিএ এলাকায় স্কুল ও পৌরসভার নিয়োগে বিরাট অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে। সেই চিঠিতে এই আর্থিক লেনদেনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। জিটিএ এলাকার স্কুলগুলিতে  ৯৩২ জন শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে। সেই চিঠির সত্যতা অনুসন্ধানে  কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু গত ৯ এপ্রিল এই নিয়োগের তদন্ত সিবিআই’র হাতে তুলে দিয়ে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট চেয়েছেন। জিটিএ’কেও রিপোর্ট দিতে হবে ১৫ দিনের মধ্যে।
২০১৭ সালের আগে থেকেই এই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি শুরু হয়েছে। গোটা রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মতই পাহাড়ের দুর্নীতিতেও রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যরা যুক্ত রয়েছেন। রাজ্য মন্ত্রিসভার ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে পাহাড়ের বিভিন্ন স্কুলে ২৯২ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।  কোনও যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা ছাড়াই সর্বোচ্চ স্তরের অনুমোদন, একেবারে সর্বোচ্চ স্তরের সবুজ সঙ্কেত পেয়েই  ২০১৭ থেকে বেআইনি নিয়োগ শুরু হয়। ২০১৭ সালে প্রাথমিকে ১২১, উচ্চ প্রাথমিকে ৫৯, মাধ্যমিকে ৪৩৯ এবং ২০১৯ সালে ৩১৩ জন শিক্ষক  মাধ্যমিকে নিয়োগ হয়েছে। বিনয় তামাঙ যখন জিটিএ’র দায়িত্বে ছিলেন তখনই শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি এই শিক্ষক নিয়োগের কারবার চালিয়েছিলেন। ২০২২ সালে জুন মাসে গণশক্তি পত্রিকায় প্রথম এই দুর্নীতির খবর সামনে আসে।
হাইকোর্টে বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসুর কাছে এই দুর্নীতি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে চিঠিও আসা শুরু হয়। তার ভিত্তিতে নিয়োগ দুর্নীতিতে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই তদন্তে কোনও  গতি ছিল না। পুলিশ এফআইআর করতেই গড়মসি করে। এরপর সিবিআই তদন্তের নির্দেশের পরেই বৃহস্পতিবার তড়িঘড়ি স্কুল শিক্ষা দপ্তরের অভিযোগকে এফআইআর হিসাবে গ্রহণ করে বিধাননগর উত্তর থানা। লিখিত অভিযোগে স্কুল শিক্ষা দপ্তর জানায়, ২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি জনৈক মুখার্জির একটি চিঠি স্কুল শিক্ষা কমিশনারের কাছে আসে। সেই দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের চিঠি রাজ্য পুলিশের ডিজি’কেও পাঠানো হয়েছিল। পার্থ চ্যাটার্জির পাশাপাশি  উত্তরবঙ্গের একজন ডিআই এবং তৃণমূলের ছাত্রনেতা তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের নামও সামনে এসেছে। 
পাহাড়ে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভও তৈরি হয়। বিভিন্ন মঞ্চ নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়। গোর্খা আনএমপ্লয়েড প্রাইমারি ট্রেনড টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন - নামক একটি সংগঠন আদালতে মামলাও দায়ের করে। শাসক তৃণমূলের হাত ধরেই পাহাড়েও দুর্নীতির এই বেনজির ছবি উপহার দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। জঙ্গলমহল থেকে পাহাড়- শাসক তৃণমূলের টাকার খিদের মাশুল দিচ্ছেন সাধারণ মানুষই।
 

Comments :0

Login to leave a comment