ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) আইনি স্বীকৃতি মিললো না এবারের বাজেটেও। এমনকি কৃষি ঋণ মকুব নিয়েও নীরব থাকলো সরকার। বস্তুত, ২০২৪-২৫ সালের বাজেটে কৃষি ও সহায়ক ক্ষেত্রে ১.৫২ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও কৃষকের সমস্যা দূর করার বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি এনডিএ সরকার। কৃষক সংগঠনগুলির অভিযোগ, কৃষিক্ষেত্রকে আরও বেশি কর্পোরেটমুখী করে তোলার প্রস্তাবই রয়েছে বাজেটে, যাতে কৃষিজাত পণ্য ব্যবসায়ে ঢালাও লুট চলতে পারে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশে কৃষি খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ৩.৫ শতাংশ। উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ সালের বরাদ্দের তুলনায় এবারের বাজেটে ৫.৪৪ শতাংশ কম বরাদ্দ করা হয়েছে টাকার অবমূল্যায়নকে গুরুত্ব না দিয়েই। শুধু তাই নয়, কম বৃষ্টিপাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০২২-২৩ সালের তুলনায় ২০২৩-২৪ সালে কৃষি বিকাশের হার ৪.৭ শতাংশ থেকে কমে ১.৪ শতাংশ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাজেট বরাদ্দ আগের তুলনায় বাড়েনি। প্রাকৃতিক কারণেই খাদ্যশস্য উৎপাদন কম হয়েছে। এমনকি গত অর্থিক বর্ষে কৃষি বরাদ্দের পুরো খরচও করে উঠতে পারেনি কেন্দ্র। বস্তুত, বাজেটে বরাদ্দ দেখানো হলেও পরে কমিয়ে দেওয়া হয় অর্থের জোগান। ফসল উৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ২৪.৭ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হয়েছে। তেমনই ২০২৩-২৪ সালের তুলনায় ৩৪.৭ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হয়েছে সারে। এর ক্ষতিকর প্রভাব আগামীদিনে কৃষিতে পড়তে বাধ্য বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অবশ্য কৃষি ক্ষেত্রকে ব্যাপকভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবার, বাজেট পেশের পরেই এমন দামামা বাজানো শুরু হয়ে গিয়েছে ‘গোদী মিডিয়া’র পক্ষ থেকে। সীতারামন কৃষি এবং সহায়ক ক্ষেত্রের বিকাশে কী কী ঘোষণা করেছেন তার ঢালাও প্রচার চলছে। দাবি করা হচ্ছে, বিজেপি সরকারের এবারের বাজেট থেকে কৃষকদেরও অনেক প্রত্যাশা ছিল। সেই প্রত্যাশাই বজায় রেখেছে কেন্দ্র। অর্থ মন্ত্রী কৃষকদের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন। জানানো হয়েছে, ২০২৪-২৫ সালের বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য কৃষি পরিকাঠামো শক্তিশালী করা, কৃষিতে প্রযুক্তির প্রচার এবং প্রাকৃতিক চাষের দিকে কৃষকদের ঝোঁক বাড়ানো। অনেকেই একে কৃষকদের প্রতি ‘উপহার’বলেও চালাচ্ছে। অনেক বড় বড় ঘোষণা রয়েছে বাজেটে। যেমন দেশের ৪০০ জেলায় ডিজিটাল পাবলিক ইনফাস্ট্রাকচার (ডিপিআই) ব্যবহার করে খারিফ ফসলের ডিজিটাল জরিপ করা হবে, যাতে ছয় কোটি কৃষক এবং তাঁদের জমির বিবরণ যুক্ত করা হবে। আগামী দু’বছরে এক কোটি কৃষককে জৈব চাষে উদ্ধুদ্ধ করা হবে। ৩২টি কৃষি ও উদ্যানপালন এলাকায় ১০৯টি উচ্চ ফলনশীল এবং জলবায়ু-বান্ধব ফসলের বীজ কৃষকদের দেওয়া হবে। গলদা চিংড়ি চাষে উৎসাহ যোগানো হবে। জন-সমর্থ ভিত্তিক কিষান ক্রেডিট কার্ড চালু হবে ৫ রাজ্যে। কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
অনেক কিছু ঘোষণা সত্ত্বেও কৃষক আন্দোলনের মূল দাবির প্রতি এবারও নজর দিলো না কেন্দ্রীয় সরকার। এমএসপি’র আইনি স্বীকৃতি, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে এমএসপি চালু এবং কৃষি ঋণ মকুবের কথা উল্লেখই করলেন না সীতারামন। একারণেই কংগ্রেস অর্থ মন্ত্রীর কৃষি সংক্রান্ত ঘোষণাকে কৃষকদের প্রতি ‘নিষ্ঠুর আচরণ’ বলে অভিযোগ করেছে কৃষক সমাজ। আন্দোলনরত কৃষকরা এবারের বাজেটে কৃষিক্ষেত্রকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ একারণেই এই বাজেটকে দিশাহীন এবং হতাশজনক বলেছেন।
একই সঙ্গে সারা ভারত কৃষক সভা মনে করে, এবার বাজেটে কৃষি ক্ষেত্রে কৃষকের কল্যাণের থেকে কর্পোরেটদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কৃষক সভা আরও বলেছে, ফসলের উৎপাদন খরচ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে এনডিএ সরকার। পাশাপাশি কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে কম হারে সুদের ব্যবস্থাও করেনি সরকার। বিদ্যুৎ এবং সারের যোগানও পর্যাপ্ত নয়। সেচের সুবিধাও বৃদ্ধি পায়নি। বস্তুত, কৃষকের প্রকৃত সমস্যার দিকে নজরই দেয়নি এবারের বাজেট।
Comments :0