Tmc scam

অভিষেকের সংস্থায় তল্লাশিতে উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া, ‘আমাদের বাড়িতে অত্যাচার’, বললেন মমতা

কলকাতা

লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে তল্লাশি মানে তা যে আসলে তাঁর ‘বাড়িতেই তল্লাশি’- এমনটাই মনে করছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই!
সারদা থেকে কয়লা পাচার কাণ্ড, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে বারেবারেই সামনে এসেছে এই বিতর্কিত সংস্থার প্রসঙ্গ। মূলত অভিষেক ব্যানার্জির নিজের সংস্থা বলেই পরিচিত লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড। ২০১২ সালে সংস্থাটি তৈরি হয়। তারপর থেকেই এই সংস্থার আর্থিক লেনদেন নিয়ে বারেবারে অভিযোগ সামনে এসেছে। সেই সময় সিপিআই(এম) নেতা গৌতম দেব প্রথম লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন নিয়ে অভিযোগ করেন।
সেই সংস্থার অফিসে তল্লাশি হতেই কার্যত ক্ষোভে ফেটে পড়লেন মুখ্যমন্ত্রী। নিউ আলিপুরের ঠিকানায় ঐ সংস্থার অফিসে সোমবার দুপুর থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত প্রায় ১৮ ঘন্টার টানা তল্লাশি অভিযান চলেছে। উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ নথি। একাধিক ভুয়ো লেনদেনের কাগজপত্রও।
বেসরকারি সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে রাতভর তল্লাশি ঘটনাকে কার্যত তাঁর নিজের বাড়িতেই  ইডি’র হানা বলে মনে করছেন মমতা ব্যানার্জি! মঙ্গলবার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ঐ বেসরকারি সংস্থায় ইডি’র তল্লাশি অভিযানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে রোজই ওরা অত্যাচার করছে। কালকেও সারারাত করেছে...’।
শুধু তাই নয়,‘ঠাকুরঘরে কে...’ গোছের মনোভাব থেকে নিজেই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে ইডি হানার ঘটনায় অভিষেক ব্যানার্জির প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ছেলেটা পরশুদিন ফিরেছে, হঠাৎ করে চলে গেছে চার পাঁচটা জায়গায়। সকাল ছটায় খবর পেলাম বাবুরা বেরিয়েছে, আমি আইনজীবীর কাছ থেকে জানতে পেরেছি।’
‘ ছেলেটা পরশুদিন ফিরেছে’ বলতে মুখ্যমন্ত্রী ২৪দিন পর বিদেশ থেকে রবিবার কলকাতায় ফেরা অভিষেক ব্যানার্জির কথাই বলতে চেয়েছে। অভিষেক ব্যানার্জি রবিবার কলকাতায় ফিরেছেন। সোমবার সকাল থেকে তাঁরই ঘনিষ্ঠ কালীঘাটের কাকুর মেয়ে-জামাইয়ের ভবানীপুরের ফ্ল্যাট সহ লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের নিউ আলিপুরের অফিস, ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রে ঐ সংস্থার দুটি কারখানায় তল্লাশির কথাই মুখ্যমন্ত্রী এদিন বোঝাতে চেয়েছেন। লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অফিসে রাতভর তল্লাশি শেষে সকাল পৌনে ছটায় বেরোন ইডি আধিকারিকরা, মুখ্যমন্ত্রী যে গোটা তল্লাশি অভিযানের খবর রাখছিলেন তাও স্পষ্ট তাঁরই কথায়।
তল্লাশি ঘটনায় ইডিকে অভিযুক্ত করেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কোথাও কোথাও তালা ভেঙেও ঢুকছে। চা করার লোক থাকলেও বার করে দেওয়া হচ্ছে। কে গ্যারান্টি দেবে ওরা নিজেরাই বিস্ফোরক, বন্দুক রেখে দেবে না। হতেও পারে কারও বাড়িতে বিস্ফোরক রেখে যাচ্ছে, কে বলতে পারে তোমরা লুকিয়ে বন্দুক রেখে যাচ্ছ না? তোমরা নিজেরাই কোটি কোটি টাকা ব্যাগে করে এনে রেখে যাচ্ছ না?’ তবে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে যে ইডি হানা দেয়নি সে খবর নিজে জানিয়েই মুখ্যমন্ত্রী বলেন ‘ওরা হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে যায়নি।’
আর এখানেই প্রশ্ন, একটি বেসরকারি সংস্থায় যেখানে শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি টাকা ঢুকেছে বলে অভিযোগ, যে সংস্থার নাম নিয়োগ দুর্নীতিতে জমা পড়া সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটেও রয়েছে সেখানে ইডি’র হানায় এতটা বিচলিত, উত্তেজিত কেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী?
লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস আসলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পারিবারিক সংস্থা। 
অভিষেক ব্যানার্জির ব্রেনচাইল্ড সংস্থা ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’। দুটি সংস্থা। একটি হলো- ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’। ২০১২ সালে এটি তৈরি হয়। দ্বিতীয়টি হলো- ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’।২০১৭ সালে এটি তৈরি হয়। দুটি সংস্থার ঠিকানাও একই- ব্লক পি, পি-৭৩৩, নিউ আলিপুর, কলকাতা-৭০০০৫৩। দুটি সংস্থাতেই বর্তমানে ডিরেক্টর দুজন- লতা ব্যানার্জি (অভিষেক ব্যানার্জির মা), অমিত ব্যানার্জি (অভিষেক ব্যানার্জির বাবা)।
তাৎপর্যপূর্ণ হলো, কয়লা পাচার কাণ্ড ও শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে সিবিআই ও ইডি তদন্ত চলাকালীন কালীঘাটের কাকুর প্রসঙ্গ সামনে আসতেই আচমকা ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’ সংস্থাই গুটিয়ে ফেলা শুরু হয়েছে। আরওসি’র তথ্য বলছে এই সংস্থার বর্তমান স্ট্যাটাস – ‘ আন্ডার প্রসেস অফ স্ট্রাইক অফ’! অর্থাৎ অভিষেক ব্যানার্জির এই পারিবারিক সংস্থা কার্যত পাতপাড়ি গোটানোর পথে। কোম্পানি অ্যাক্ট, ২০১৩’র  ২৪৮ নম্বর ধারায় এই কোম্পানির ‘স্ট্রাইক অফ’ করা যায় যখন কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস সেই সংস্থা আর জীবিত রাখতে চায় না। 
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার একটি নির্দিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’ নামক এই সংস্থাতেও কয়লা পাচারের টাকা ঢুকেছে, ঘুরপথে। একটি নির্মাণকারী সংস্থার মাধ্যমে, সেই সংস্থার সঙ্গে আবার সরাসরি যোগ কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার। টাকার পরিমাণ ৪ কোটি ৩৭ লক্ষ।
একটি কোম্পানি গোটানো শুরু হয়েছে। অপর কোম্পানি অর্থাৎ লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেডের নিউ আলিপুরের ঐ ঠিকানায় এবং অভিষেক ব্যানার্জির লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিষ্ণুপুর-২ ব্লকের সাঁজুয়ায় লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের জলের কারখানাতেও তল্লাশি চালায় ইডি। এই সংস্থাতেই একসময় অভিষেক ব্যানার্জি এই সংস্থার কর্ণধার ছিলেন। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে বোর্ড অফ ডিরেক্টরস থেকে পদত্যাগ করেন।  বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে কালীঘাটের কাকুও ছিলেন সে সময়। এখন অভিষেকের বাবা-মা’ই এই সংস্থার অন্যতম দুই ডিরেক্টর।
আর তাই তল্লাশি অভিযানে রীতিমত ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী! এদিন তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে প্রায় হাজার পাতার নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। শুধু নিয়োগ দুর্নীতির টাকা ঢুকেছে এই সংস্থায় তা নয়, লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের জলের কারখানার আর্থিক লেনদেন নিয়ে গুরুতর দুর্নীতির ছবি সামনে এসেছে। কালো টাকা খাটানো হয়েছে সেখানে, ভুয়ো বিল বানিয়ে শিখণ্ডী সংস্থার সঙ্গে লেনদেন দেখিয়ে কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। সেই নথিও এবার হাতে এসেছে ইডি’র।
এর আগে নিয়োগ দুর্নীতির চার্জশিটে ইডি উল্লেখ করেছিল কালীঘাটের কাকুর সংস্থা এসডি কনসালটেন্সির মাধ্যমেই ২০২০সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২১’র জানুয়ারি পর্যন্ত তিন দফায় মোট ৯৫লক্ষ টাকা ঢুকেছিল লিপস অ্যান্ড কালীঘাটের কাকুর সংস্থা এসডি কানসালেটন্সিকে ‘পরামর্শ’ দেওয়ার বিনিময়ে এই টাকা দেওয়া হয় লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসকে। কোনরকম বিনিয়োগ ব্যবসা ছাড়া টাকা ঢুকেছিল এই সংস্থায়। গোটা কারবারটি শুধু খাতায় কলমে দেখানো হয়েছে। বানানো হয় ভুয়ো বিল।
ফলে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে ইডি’র হানা যে কার্যত তাঁর বাড়িতেই তদন্তকারী সংস্থার ঢুকে পড়ার শামিল, তা মনে করছে খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment