একটু অপেক্ষা
জয়তী চট্টোপাধ্যায়
" আচ্ছা বক্সিগঞ্জটা কোথায়!"
" সিধে চলে যান। নাক বরাবর। তারপর বাঁয়ে ঘুরেই ডান দিকে। " বলেই সাইকেল আরোহী মোড় ঘুরল।
কিশলয় আর মিশুকের খটকা লাগল একটু। সুকুমার রায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
ওরা দুই বন্ধু। থাকে উত্তর কলকাতার কালিকিঙ্কর লেনে। পরীক্ষা শেষ। দুজনেই অবসর পেলে টুকটাক টিকটিকির কাজ করে। শখের গোয়েন্দা আর কি! কিছু লিফলেট ছাপিয়ে নানা জায়গায় পোস্ট মেরে দিয়েছে। " সত্য সন্ধানীর কাছে আসুন। শীঘ্র সমাধান।" নিচে ফোন নম্বর।
২৫ বৈশাখ এক অদ্ভুত ফোন এল।
" আমি নলিনাক্ষ সেন বলছি। বক্সিগঞ্জ থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে কিছু গোপন তথ্য আপনাদের জানাতে চাই।"
ঠিকানা দিলেন। কলকাতা থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে। সেই ফোনকলে সাড়া দিয়েই ওদের অভিযান।
গাড়ি করেই গেল। সহজেই বাড়ি পাওয়া গেল। বাগানের গেট খোলাই ছিল। প্রচুর গাছগাছালি। অবাক কাণ্ড। প্রতিটি গাছের নিচে রবীন্দ্রকাব্যের নাম। চিত্রা, পুনশ্চ, সোনার তরী, স্ফুলিঙ্গ, আরও কত শত। মোবাইলে মিস কল দিল মিশুক।
বাড়ির দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন তাঁকে দেখে চমকে উঠল ওরা। বৃদ্ধ ভদ্রলোক। বেশভূষায়, কথাবার্তায় রবিঠাকুর কে কপি করার বৃথা চেষ্টা।
" এসো তোমরা। একটু বিশ্রাম নাও। জলখাবার খাও। কেষ্ট কলকাতার বাবুদের ঘরটা দেখিয়ে দে। একটু হেসে বললেন 'মোর পুরাতন ভৃত্য'।"
ঘরটি ভারি সুন্দর। রবীন্দ্রনাথের নানা বয়সের, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সব ছবি।দেওয়ালে একটা টিকটিকি বসারও জায়গা নেই ।
জলখাবার দেখে দুজনের চক্ষু স্থির। সবটাই সাপটে খেয়ে নিল। বারোটা নাগাদ নলিনাক্ষ সেন এলেন।
" আমরা তো আজকেই ফিরে যাব। যদি তাড়াতাড়ি কথাগুলো বলেন..."
মিশুকের গলায় মিনতি।
"তোমরা বড্ড ছোট। বিশ্বাস করতে পারি কী! প্ল্যানচেট মানো!
আসলে সবটাই ঘটেছিল আমার বড়দাদুর আমলে। প্ল্যানচেটের খুব শখ ছিল। ভাল মিডিয়াম ছিলেন। ধীরে ধীরে অশরীরী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। প্ল্যানচেটে লেখা বিনিময়ের সূত্রেই অনেক জানা, অজানা কথা রবি ঠাকুর ওঁকে জানিয়েছিলেন।
" আপনার কাছে প্রমাণ আছে! "কিশলয় জিজ্ঞেস করে। উঠে গিয়ে একতাড়া কাগজ নিয়ে এলেন। ধূসর,মলিন কাগজে আঁকাবাঁকা অক্ষরে প্রচুর লেখা। " কী করে বুঝলেন এই ব্যাপারটা ভাঁওতা নয়!"
" লাভ কী বাবারা! শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সব কথা সত্যান্বেষীকে জানিয়ে যাওয়া উচিত মনে করলাম। তোমরা কাগজগুলো নিয়ে যাও। আচ্ছা জানো কী আন্নাকালী পাকড়াশি, দিকশূন্য ভট্টাচার্য , বাণীবিনোদ বন্দোপাধ্যায়, শ্রীমতী মধ্যমা আরও বেশকিছু ওঁর ছদ্মনাম! "
মিশুক, কিশলয় মাথা নাড়ল। ভানুসিংহ ছাড়া আর কিছুই ওদের জানা নেই। ভরপেট খেয়ে সন্ধে নাগাদ ওরা কলকাতায় ফিরল। রাস্তায় অন্তত বার তিরিশেক মাইকে শুনল " হে নুতন, দেখা দিক আরবার..."
তর সইছিল না। সাতটা নাগাদ দুজনেই গেল পাপাই কাকুর বাড়ি। উনি হস্তলিপি বিশারদ। সব কথা সংক্ষেপে জানাল। কাকু সব মিলিয়ে দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন।
" তোদের স্রেফ বোকা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। "
মলিন মুখে দুই বন্ধু বাড়ি ফিরল। ওদের এই অভিযানের কথা ভাগ্যিস কেউ জানে না।
দুদিন পরে। সকাল হতেই মিশুক ছুটে এল। মুখে কথা নেই। হাতে নিউজ পেপার। আন্ডারলাইন করা আছে।
"বক্সিগঞ্জে এক বৃদ্ধের রহস্য জনক মৃত্যু।২৫ বৈশাখ। নাম, নলিনাক্ষ সেন। খবরে প্রকাশ তিনি স্বাভাবিক ছিলেন না। প্রচণ্ড রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী ছিলেন। ডাক্তার বলেছেন অবিশ্বাস্য কিছু প্রত্যক্ষ করে হঠাৎ হার্টফেল। চোখদুটি বিস্ফারিত ছিল। শুয়েছিলেন অজস্র রবীন্দ্রনাথের বই আর ছবির মধ্যে। আর কিছু হিজিবিজি লেখা কাগজ। "
ওরা বিশ্বাস করতে পারছিল না। সত্যি কী রবি ঠাকুরকে দেখলেন শেষ সময়ে!
হঠাৎ লাফিয়ে উঠল মিশুক। "আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের সত্যি লেখা আর প্ল্যানচেটের লেখা কখনও এক হতে পারে কী!"
" কক্ষণই নয়।" সজোরে মাথা নাড়ল কিশলয়।
এ কথাটা কেন মাথায় আসেনি!ওই কাগজের তাড়ার মধ্যে থাকতেই পারে কিছু অজানা কথা।
অতএব! চলুক দুই বন্ধুর সত্য সন্ধানের পথে অভিযান। অপেক্ষা করাই যেতে পারে। অঘটন আজও ঘটতে পারে বই কী!
Comments :0