GK — TAPAN KUMAR BAIRAGYA / NATUNPATA - 29 DECEMBER

জানা অজানা —পালকি এখন জাদুঘরে / তপন কুমার বৈরাগ্য / নতুনপাতা / ২৯ ডিসেম্বর

ছোটদের বিভাগ

GK  TAPAN KUMAR BAIRAGYA  NATUNPATA - 29 DECEMBER

নতুনপাতা

জানা অজানা

পালকি এখন জাদুঘরে
তপন কুমার বৈরাগ্য

দিনের পর দিন আমরা কত দুর্লভ জিনিস হারাতে বসেছি তার শেষ নেই।
যুগের তালে চলতে গিয়ে আমরা ভালো কিছু হারিয়ে অনেক খারাপকে
সঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছি। এর ফলে পৃথিবীতে আমরা দূষণকে ডেকে
এনেছি।আমাদের হাতে সময় খুব কম।তাইতো ধীরগামী যান একে
একে বিদায় নিয়েছে। এসেছে রিক্সা,বাস,টো টো, ট্রেন,বাস,উড়োজাহাজ
ইত্যাদি। আজ থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগেও পালকির অস্তিত্ব ছিল।
পালকি একরকম বিলাসবহুল যান। যাতে কোন চাকা নেই।চারজন বা
ছ'জন জোয়ান মরদ ঘাড়ে করে পালকি বহন করে নিয়ে যায়। সামনে
দু'জন বা তিনজন,পিছনে দু'জন বা তিনজন। পালকি যারা বহন করে
নিয়ে যায় তাদের পালকি বেহারা বলে।পালকি যখন বহন করে তখন
পালকি বাহকদের হাতে এক একটা শক্ত লাঠি থাকতো। পালকি বাহকদের
দেহের বিশেষত্ব তাদের দেহ হতো ইস্পাতের মতো শক্ত।খালি গায়ে
তারা পালকি বহন করে নিয়ে যেত। ছন্দের জাদুকর  সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে পালকির গান কবিতায় লিখেছেন--
পালকি চলে ,পালকি চলে,গগন তলে, আগুন জ্বলে;স্তব্ধ গায়ে,আদুল গায়ে,
যাচ্ছে কারা,রৌদ্রে সারা।
পালকি বাহকদের রৌদ্র বৃষ্টি উপেক্ষা করে পালকি বহন করে নিয়ে
যেতে হতো।কখনো কখনো দীর্ঘ পথ তাদের পাড়ি দিতে হতো।পালকি বহনের
কাজই তারা জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। শুনলে অবাক হতে
হয় আজ থেকে একশো বছর আগে একজন পালকি বাহক সারাদিন
খেটে পঞ্চাশ পয়সা মজুরি পেত।।


পালকি শব্দটি এসেছে পালঙ্ক থেকে। ভারতবর্ষে আনুমানিক যীশুখ্রিষ্ট্রের
জন্মের আড়াইশো বছর আগেও পালকির প্রচলন ছিল। তার উল্লেখ আছে
রামায়ণে। তবে প্রাচীনকাল থেকেই দেখে আসছি পালকি ব্যবহার করতো
অভিজাত শ্রেণিরা। ইংরেজরা এদেশে আসার পর ঘোড়ার গাড়ি বা পালকি
ব্যবহার করতো।পালকি সাধারণতঃ আয়তাকার বা বর্গাকার হতো ।দুদিকে লম্বা দুটি
হাতল। পালকি বেশি ভাগ ক্ষেত্রেই শক্ত মজবুত কাঠ দিয়ে তৈরি করা হতো।
একটা পালকিতে তিনজনের জায়গা হতে পারে।পালকিতে দুদিকে দুটো
দরজা ও সামনে পিছনে বা দুইপাশে ছোট ছোট দুটো জানালাও থাকতো।
একটা পালকিকে নানাভাবে সাজিয়ে তোলাও হতো।প্রজাপতি,ফুল,
দেবদেবীর ছবি,সুন্দরী নারীদের ছবিও থাকতো। পালকিতে শিল্পীর
শিল্পকার্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠতো।পালকি যারা তৈরি করতেন তারা সব
সেই সময়ের সুদক্ষ শিল্পী ছিলেন।
পালকির কিছু সমার্থক শব্দ আছে।যেমন ডুলি,শিবিকা। পৃথিবীর মধ্যে
ইউরোপ মহাদেশে সবচেয়ে পালকির ব্যবহার বেশি ছিল।ইউরোপে
রেলগাড়ি চলার আগে পর্যন্ত  ইউরোপের সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন যেমন
রাজা রানিরা পালকি চড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেন।
যখন পালকি করে যেতেন তখন দু'পাশে দু'জন সুদৃশ্য পাখার দ্বারা
তাদের হাওয়া করতে করতে যেতেন।
পালকির এক এক দেশে এক একরকম নাম ছিল।যেমন প্রাচীন রোমে
নাম ছিল লেটিকা।এর আকৃতি আমাদের দেশের পালকির চেয়ে অনেকটা
বড়।এতে শোবার পর্যন্ত জায়গা থাকত। চীনে এর নাম ছিল জিয়াও।
চীনের সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীরা এই পালকি ব্যবহার করতেন।
ইংল্যান্ডে পালকির নাম ছিল সিড্যান চেয়ার।ইংল্যান্ডের রাজা ও রানিরা
এই পালকি করে এক প্রাসাদ থেকে আর প্রাসাদে যাতায়াত করতেন।
এইভাবে পালকির এক এক দেশে এক এক ধরনের নাম ছিল।
তবে সব দেশেই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাই পালকি ব্যবহার করতেন।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে পালকির
উল্লেখ আছে। পালকি বাহকেরা আবার ছড়াকারও ছিলেন।
তারা মুখে মুখে ছড়াও বানাতে পারতেন।এইরকম একটা ছড়া--
কর্তাবাবুর রঙটি কালো
গিন্নি মায়ের মনটি ভালো
সামনে চলো হেঁইও।


তখনকার দিনে পথেঘাটে ডাকাতের উপদ্রব ছিল।তাই রাতে
পালকি বাহকদের সাথে হাতিয়ার সমেত দু'একজন পহারাদারও
থাকতেন।কলকাতায় ১৯৩০সালে রিক্সার প্রচলন হলে কলকাতায়
পালকির ব্যবহার কমে যায়। এখন পালকির ব্যবহার নেই বললেই
চলে।দু 'একটা বিয়েতে পালকির ব্যবহার করা হয়।তবে তাহা
লাখোতে একটা।শান্তিপুরের ভাঙ্গারাসে দেবদেবীদের নিয়ে
যাওয়ার জন্য এখনো পালকি ব্যবহার করা হয়।
আজকের প্রজন্মের শিশু কিশোররা পালকির কথা শুনলে
অবাক হয়ে যায়। এখন পালকির সাথে পরিচিত হবার জন্য তাদের
অবশ্যই জাদুঘরে যেতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment