Modi Speech in LS

আদানি নিয়ে নিশ্চুপ থেকে আড়ালই করলেন মোদী

জাতীয়

গৌতম আদানির সঙ্গে সখ্যের অভিযোগের জবাব না দিয়ে সংসদে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বিষয় নিয়ে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ শোনালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আবার বিরোধীদের বিদ্রুপ করে বললেন, ‘‘ভোট ওদের ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হলেও ইডি ওদের এক জায়গায় এনে দিয়েছে।’’ এরই সঙ্গে ইউপিএ সরকারের দশ বছরকে ‘রক্তক্ষরণে শুকিয়ে গিয়েছিল দেশ’ বলে কটাক্ষও করেন। ওই আমলে কী পরিমাণ কেলেঙ্কারি হয়েছে, দেশজুড়ে হিংসার রাজত্ব চলেছে বলে পালটা অভিযোগও করলেন মোদী। কিন্তু এত কিছুর পরেও আদানিদের নিয়ে একটি শব্দও মুখে আনলেন না তিনি। তাঁর এই ভাষণকে ‘আদানিদের আড়ালের কৌশল’ বলে অভিযোগ করলেন বিরোধীরা।


মোদী বুধবার লোকসভায় টানা ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ভাষণ দেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদসূচক বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি শূলে চড়ালেন বিরোধীদেরই। এর কারণ অবশ্য আদানিদের শেয়ার কারচুপি নিয়ে বিরোধীদের যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করে তদন্তের দাবির পাশাপাশি মঙ্গলবার লোকসভায় মোদী-আদানি ঘনিষ্ঠতা নিয়ে চাঁচাছোলা বক্তব্য রাখেন রাহুল গান্ধী। এমনকি এবিষয়ে মোদী সহ গোটা সরকার নিশ্চুপ কেন, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন বিরোধীরা। কিন্তু এদিন ভাষণ দেওয়ার সময় মোদী সুচতুরভাবে আদানি প্রসঙ্গ এড়িয়ে উলটে কংগ্রেস সহ বিরোধীদের নানাভাবে আক্রতমণ করে গেলেন। তবে এই আক্রমণের নামে তাঁর রাজত্বের ৮ বছরকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে যা বললেন, তা নিয়েও হাজারও প্রশ্ন থেকে যায়। যা বললেন বিরোধীরা ইচ্ছা করলে সেগুলি নিয়ে উলটে তাঁকেও চেপে ধরতে পারেন।
এদিন বিরোধীদের আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি মূলত বেছে নেন ২০০৪-২০১৪ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ আমলকে। তিনি বলেন, ‘‘ওই এক দশক হলো কেলেঙ্কারি এবং হিংসার। ইউপিএ’র ট্রেডমার্ক-ই হয়ে গিয়েছিল যে যে কোনও সুযোগ উলটে সঙ্কটে পরিণত করা।’’ দেশের বেহাল দশা হলেও তিনি সেই ৫৬ ইঞ্চি ছাতির গল্পই শোনালেন। তাঁর দাবি, ‘‘কংগ্রেস তাঁকে অপদস্ত করার চেষ্টা করলেও দেশের ১৪০ কোটি জনগণ তাঁর ঢাল হয়ে দাঁড়াবে।’’ তিনি মনে করেন, ‘‘বিরোধীরা এতটাই হতাশায় ভোগে যে দেশের অগ্রগতি তাদের চোখেই পড়ে না।’’ এটার কারণ নাকি তাঁর বোধগম্য হয় না।
এরপরে তিনি যা বললেন তার প্রতিটি বিষয় নিয়ে তাঁকেই উলটে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারেন বিরোধীরা। এখন দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.৮৮ শতাংশ হলেও তিনি উলটে ইউপিএ আমলের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে গাল পাড়লেন। এই ৮ বছরে একটার পর একটা কেলেঙ্কারি সামনে আসার পরেও তিনি বলেন, ওই ১০ বছর কেটেছে শুধু কেলেঙ্কারিতেই।’’ আবার এই মোদীই কিন্তু এখনকার আলোচনার মূল কথা সেই আদানিদের কেলেঙ্কারি নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের পর সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বাড়েনি বই বেড়েছে। তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকই সেই তথ্য পেশ করছে সংসদে। অথচ মোদী এদিন বললেন, ওই ১০ বছরে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ছিল সন্ত্রাসবাদীদের রাজত্ব। উত্তর-পূর্ব ভারতে এই ৮ বছরে বিভিন্ন বিষয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও মোদীর দাবি, ‘জম্মু-কাশ্মীর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত সেই সময় একটার পর একটা হিংসাত্মক কার্যকলাপের শিকার হয়েছে। তাঁর আমলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নাকি ভারতের ছাতি ওঁর মতোই ৫৬ ইঞ্চি বেড়ে গিয়েছে, এমনই দাবি করলেন মোদী। তাঁর দাবি, ওই সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমন অবস্থা হয়েছিল যে ভারতের কথা কেউ শুনতই না। তিনি যখন এসব কথা বলছেন তখন বিরোধীরা বারবার ‘আদানি’ ‘আদানি’ চিৎকার করে যান। আর শাসক দলের সাংসদরা টেবিল চাপড়ে মোদীকে আরও উৎসাহিত করেন।


বিপুল উৎসাহে মোদী বলেন, ‘দেশের ভোটাররা যে কাজ করতে পারলেন সেই কাজটি সহজেই করে ফেলেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি।’ অর্থাৎ কোনও কর্মসূচি নয়, স্রেফ তদন্তকারী সংস্থার আতঙ্কে বিরোধীরা নাকি মঞ্চে এসেছে, এমনই দাবি মোদীর। তাদের এক মঞ্চে আনার জন্য ইডি-কে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত বিরোধীদের, কটাক্ষ তাঁর। এমনও দাবি করেন যে গত ৯ বছর ধরে বিরোধীরা ভিত্তিহীন অভিযোগ করে আসছে। গঠনমূলক সমালোচনার বদলে ‘করতে হয় তাই করছে’ গোছের সমালোচনা করে বিরোধীরা। রাহুল তাঁর বক্তব্যে মোদী আমলের রাজনীতি-বাণিজ্য নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করতে পারে এবং সেই বিষয়ে স্বর্ণপদক পেতে পারেন মোদী বলে কটাক্ষ করেছিলেন। তাঁর জবাবে এদিন মোদী বললেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উত্থান এবং পতন নিয়ে গবেষণা করতে পারে।
মোদীর ভাষণের বেশিরভাগ সময় অনুপস্থিত ছিলেন রাহুল। তিনি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মোদীর তির্যক মন্তব্য, ‘‘কিছু মানুষ ঘুমাতে ভালোবাসেন। তাঁদের এখনও ঘুম ভাঙেনি।’’ তাঁর দাবি, ‘‘শুধু খবরের কাগজ কিংবা টেলিভিশনে ছবি দেখে তাঁকে আমজনতা ভালোবাসেন না। ভালোবাসেন জনগণের জন্য তাঁর আত্মোৎসর্গ দেখে।
এদিকে এদিন লোকসভার কার্যবিবরণী থেকে রাহুল গান্ধীর ভাষণ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অধ্যক্ষ ওম বিড়লা। তিনি নাকি প্রমাণহীন ব্যক্তিকেন্দ্রিক বক্তব্য রেখেছেন এই যুক্তিতে বাদ দেওয়া হলো তাঁর ভাষণ। একইভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস সদস্য মহুয়া মৈত্রর বক্তব্যও। আবার রাহুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও তুলেছেন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী। তবে রাহুলের বক্তব্য কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হলেও তার আগে সংবাদমাধ্যমের দৌলতে জেনে গিয়েছে গোটা দেশ। রাহুলের ভাষণকে বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে এদিন কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ টুইট করে বলেছেন, ‘গণতন্ত্রকে কবর দেওয়া হলো’।
পরে রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘উনি স্পষ্টতই গৌতম আদানিকে আড়াল করতেই ওই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন। এর পিছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। এমনকি আদানিদের বিরুদ্ধে শেয়ার কারচুপির যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তার তদন্তেরও নির্দেশ দিলেন।’’ শুধু তাই নয়, তিনি যেসব অভিযোগ করেছিলেন, তার জবাবও এড়িয়ে যান মোদী বলে অভিযোগ করেন রাহুল।
এদিকে, এদিন আদানি নিয়ে উত্তাল হয় রাজ্যসভাও। কংগ্রেস দলনেতা মল্লিকার্জ্জুন খাড়গে যৌথ সংসদীয় কমিটি দিয়ে আদানির শেয়ার কারচুপির অভিযোগ তদন্তের দাবিতে অনড় অবস্থান নেন। তাঁর অভিযোগ, ওই শিল্পপতির উত্থানের পিছনে প্রধানমন্ত্রীর হাত আছে। তাঁকে নিরস্ত করতে রাজ্যসভার চেয়ারপারসন জগদীপ ধনখড় বলেন, খাড়গে নাকি দেশবিরোধী মন্তব্য করেছেন। তখন বিরোধী সদস্যরা ধনখড়কে চাপ দিতে থাকেন যে, খাড়গে কী ধরনের দেশবিরোধী মন্তব্য করেছেন তা তাঁকে বলতে হবে। খাড়গেও বলেন, তিনি সত্য যা তাই বলেছেন। সেটা কেন দেশবিরোধিতা হতে যাবে।


এদিন বিতর্কে অংশ নিয়ে সিপিআই(এম) সদস্য বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সরকার কতটা শক্তিশালী তা নির্ভর করে বিরোধীদের শক্তির ওপর। যদি সরকার নির্দোষই হয় তাহলে তারা তদন্তের নির্দেশ দিতে ভয় পাবে কেন? ওই কর্পোরেট সংস্থাকে নিয়ে গোটা বিরোধীপক্ষ তদন্তের দাবি জানাচ্ছে। তাহলে সরকার পিছিয়ে যাচ্ছে কেন?’’ এরপরেই তিনি চেয়ারপারসনের আরজি জানান জেপিসি গঠনের। জেপিসি গঠনের দাবিতে সরব হন সিপিআই(এম) সদস্য জন ব্রিটাস। তিনিও সরকারের সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতার কথা তুলে দরেন তাঁর বক্তব্যে।
এদিন মোদী আদানিদের নিয়ে নিশ্চুপ থাকার কৌশল নিলেও তাঁর মদতপুষ্ট ‘ধান্দার পুঁজিবাদ’ নিয়ে প্রশ্ন মোটেই উবে যাচ্ছে না বলে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। টুইট করে তিনি বলেছেন, প্রমাণ হাজারও— সরকারি এজেন্সি থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার, সবই আছে। এই সত্য থেকে পালিয়ে পার পাওয়া যাবে না।

 

Comments :0

Login to leave a comment